প্রকৃতি বলতে জাগতিক বিশ্বের মানব সৃষ্ট-নয় এমন দৃশ্য-অদৃশ্য বিষয় এবং জীবন ও প্রাণকে বুঝায়। এই প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত সব সামুদ্রিক শৈবাল ও শৈবালজাত পণ্য মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে শৈবালের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে।
দেশেও তাই ক্রমে বাড়ছে ‘সবুজ সোনা’ খ্যাত এই শৈবাল চাষ। পর্যাপ্ত সুযোগ পেলে পণ্যটি হয়ে উঠতে পারে অন্যতম রপ্তানি পণ্য।
বর্তমানে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র ও অতি দরিদ্র জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন বাণিজ্যিকভাবে শৈবাল উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন। আর প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন শৈবালের মধ্যে স্পিরুলিনা প্রজাতির শৈবালের মধ্যে এমন কিছু গুণাগুণ রয়েছে যা আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় কাজেও ব্যবহারযোগ্য।
নীলাভ সবুজ এই শৈবালের রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ই এবং বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন বি, সি, ডি, ই, কে। রয়েছে অনেক সমৃদ্ধ ওষুধি গুণও। তাই মানুষের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি গেলো কয়েক বছর ধরে ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে সবুজ এই শৈবাল। সব মিলিয়ে এই খাদ্যপণ্যটি এখনও অনেকের কাছে নতুন মনে হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের মধ্যে সামুদ্রিক শৈবাল খাদ্য হিসেবে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এই সবুজ শৈবাল সাধারণত দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে চাষ হলেও এবার বরেন্দ্রভূমি খ্যাত রাজশাহীর তানোর উপজেলার আমশো গ্রামে বাণিজ্যিকভাবেই চাষ হচ্ছে। সামুদ্রিক এই শৈবাল চাষে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত কাজে লাগিয়ে স্থানীয় কলেজ শিক্ষক রাকিবুল সরকার পাপুল তার পরিত্যক্ত ধানের চাতালে কৃত্রিম জলাধার তৈরি করে ফেলেছেন। এখন সেখানেই বাণিজ্যিকভাবে শৈবাল চাষ শুরু করেছেন এই কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে এটি শৈবাল চাষের জন্য দেশের সর্ববৃহৎ জলাধার।
প্রথমে ইউটিউবের একটি ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে চাষযোগ্য শৈবালের ব্যাপারে জানতে পারেন পাপুল। পরে গত জানুয়ারিতে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জালাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর তিনি ঝিনাইদহের শৈবালচাষি দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে আট হাজার টাকার বিনিময়ে স্পিরুলিনা উৎপাদনের প্রশিক্ষণ নেন। তার সঙ্গে নূর মোহাম্মদ নামে আরও একজন প্রশিক্ষণ নেন। এরপর বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে তিনিই প্রথম এই শৈবালের চাষ শুরু করেন।
সমুদ্রের শৈবাল খামারে চাষ করে এরই মধ্যে সাড়া ফেলেছেন পাপুল। তার পরিত্যক্ত ধানের চাতালে বর্তমানে ১৭ হাজার লিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জলাধার রয়েছে। এটি তারই তৈরি করা। এখানেই বাণিজ্যিকভাবে চলছে স্পিরুলিনার চাষ। গত ৪ মার্চ থেকে স্পিরুলিনার আহরণ শুরু হয়েছে। পুষ্টিকর খাদ্য বিবেচিত এই সবুজ শৈবাল চাষ করেই এখন কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন পাপুল।
বিশাল এই জলাধার ঘিরে সূর্যের আলো ঢোকার মতো স্বচ্ছ প্লাস্টিক টিনের ঘর তৈরি করেছেন তিনি। যেহেতু এরা সূর্যের আলো থেকে খাবার তৈরি করে সেজন্য স্বচ্ছ টিন ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। বীজ হিসেবে গত ৪ জানুয়ারি শৈবালসহ ১৫ লিটার পানি তার জলাধারে দেন।
খোলা জায়গায় স্পিরুলিনা চাষের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা এই কৃত্রিম জলাধারের চারিদিকে নেট জাল আর পলিথিন দিয়ে নিখুঁতভাবে ঘিরতে হয়েছে। এরপর কৃত্রিম উপায়ে ১৭ হাজার লিটার পানিতে এ শৈবাল বেড়ে উঠছে। সমুদ্রের পানির উপাদানের জন্য জলাধারে ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। ওষুধ প্রয়োগে এ পর্যন্ত তার এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এই ওষুধেই ছয়মাস চলবে। এরপর পানির মাত্রা কমে গেলে তা বাড়াতে আবারও প্রয়োজন অনুপাতে একই উপাদান দিতে হবে।
নতুন উদ্যোক্তা রাকিবুল সরকার পাপুল জানান, দেশের প্রায় দেড়শ জলাধারের মধ্যে এটি সর্ববৃহৎ। গত ৪ জানুয়ারি ‘বীজ’ জলাধারে ঢালার পর কৃত্রিম উপায়ে শৈবাল বড় হচ্ছে। এক সপ্তাহ পরপর আহরণের পাশাপাশি, মাসে শুকনো শৈবালের পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ কেজি হচ্ছে। রোদ বেশি থাকলে উৎপাদন বেশি হবে। ছাঁকনি দিয়ে শৈবাল সংগ্রহ করা হয়। কাঁচা শৈবাল শুকালে ওজন হয়ে যায় আগের তিন ভাগের এক ভাগ। ৩ হাজার টাকা কেজি দরে এ শৈবাল বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত সাড়ে ৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। আশা করছেন ৬ মাসে এ বিনিয়োগ উঠে আসবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে রঙিন মাছ চাষের জন্যও স্পিরুলিনা অনেক দামে থাইল্যান্ড থেকে আনা হচ্ছে। কিন্তু দেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হলে এর দাম অনেক কমে যাবে। ওই শৈবালের মধ্যে ক্ষতিকর বস্তু তো নেই-ই বরং এর পুষ্টিমান ডিম, দুধ, মাংস, মাছ ও শাকসবজির চেয়েও বেশি।
এদিকে, স্থানীয়ভাবে ব্যক্তি উদ্যোগে রাজশাহীর তানোর স্পিরুলিনার চাষ শুরু হলেও এখনও তা জানে না কৃষি বিভাগ। তবে এমন চাষাবাদ প্রশংসনীয় বলে উল্লেখ করেছেন- ইউএনও।
রাজশাহীর তানোরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার মাহাতো বলেন, এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। দেশের অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ‘স্পিরুলিনা’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিষয়টি নতুন হলেও কৃষি বিভাগের সঙ্গে কথা বলে এর বাণিজ্যিক চাষ, উদ্যোক্তা তৈরি ও বাজারজাতকরণের ব্যাপারে ভবিষ্যতে আমরা সাধ্যমতো সহায়তা দেবো।
জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, বর্তমানে শৈবাল থেকে খাদ্যপণ্য, ওষুধি পণ্য, প্রসাধনী পণ্য, সার, বায়ো ফুয়েল এবং পরিবেশ দূষণরোধক পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। লবণাক্ত, আধা লবণাক্ত পানিতে এই শৈবাল জন্মে এবং অল্প খরচে খুব সহজ পদ্ধতিতেই তা চাষাবাদ করা যায়। এ কারণে সামুদ্রিক শৈবাল বিভিন্নভাবে ব্যবহারের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানিরও সুযোগ রয়েছে।