গদখালী ফুলের রাজ্য যশোরের। এই এলাকার নারাঙ্গালী গ্রামের চাষি আবু তাহের। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, মুজিববর্ষ, পয়লা ফাল্গুন, পয়লা বৈশাখসহ বেশ কয়েকটি দিবসকে সামনে রেখে ১৯ বিঘা জমিতে সাদা গ্লাডিওলাসের চাষ করেছিলেন। পাশাপাশি সাড়ে ১০ বিঘা জমিতে চাষ করেছিলেন দুই জাতের রজনীগন্ধা।
আবু তাহের বলেন, ‘সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে কম করে হলেও গত দুই মাসে ২০ লাখ টাকার ফুল আমি বিক্রি করতে পারতাম। করোনা মহামারী সব শেষ করে দিয়েছে। সব ফুল খেতেই পচে নষ্ট হয়ে গেছে। ২০ লাখ টাকার স্বপ্ন তো গেছেই, চাষের পেছনে যে খরচ, তাও গেছে পানিতে।’ ফুল চাষ করতে গিয়ে চারটা এনজিও থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন আবু তাহের। বললেন, ‘কিস্তি নিতে এখন এনজিওগুলো আসছে না, তবে ফোন দিচ্ছে, তাড়াতাড়িই আসবে।’ সব মিলিয়ে ভবিষ্যতের দুঃশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ বাড়ছে তার।
কুলিয়া গ্রামের ফুলচাষি শের আলীর ছয় বিঘা জমিতে গ্লাডিওলাস আর দেড় বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা ছিল। ১৮ মার্চ থেকে গদখালী বাজারে ফুলের কেনাবেচা একেবারে বন্ধ। দুই মাস খেতমুখো হননি। বললেন, ‘ফুল সব খেতেই নষ্ট হয়েছে, লোকজন খেতে গরু-ছাগল ছেড়ে ফুলের গাছ, ফুল খাইয়ে দিয়েছে। ৩-৪ লাখ টাকার ক্ষতি তো হয়েছেই। নতুন চাষের জন্য ৮০ হাজার টাকা দিয়ে কেনা ১০ বস্তা গ্লাডিওলাসের বীজ কিনে বাড়িতে রেখেছি। ৮-১০ দিনের মধ্যে এগুলো রোপণ করতে না পারলে নষ্ট হয়ে যাবে। চারদিক থেকে ক্ষতি হচ্ছে।’ কৃষি ব্যাংক থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। এ টাকা কীভাবে শোধ করবেন তা নিয়েও দুঃশ্চিন্তায় আছেন। হাড়িয়া গ্রামের ইমামুল হোসেন তিন বিঘা জমিতে চাষ করেছিলেন ব্যয়বহুল জারবেরা ফুল। এ খেত পরিচর্যায় প্রতি মাসে তার খরচ হয় ৬০ হাজার টাকা। প্রতিদিন দুজন শ্রমিক লাগে। ফুল বিক্রি হোক বা না হোক, প্রতিদিন দুবার ফুল ভাঙতে হয়। গত দুই মাসে তিনি এক টাকার ফুলও বিক্রি করতে পারেননি। ইমামুল বলেন, ‘জারবেরার জমি তৈরির জন্য ব্যাংক ও এনজিও থেকে সাত লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। এ টাকা কীভাবে শোধ করব, বুঝতে পারছি না। একটি এনজিও গত সপ্তাহেও কিস্তির জন্য তাগাদা দিয়ে গেছে।’
পানিসারা গ্রামের ফুলচাষি মহিদুল সর্দার বলেন, ‘করোনা মহামারীর কারণে আমার এক বিঘা জমির গ্লাডিওলাস আর এক বিঘা জমির রজনীগন্ধা খেতেই পচে গেছে। ৩০ হাজার টাকা খরচ করে এক বিঘা জমিতে গাঁদা ফুল লাগিয়েছিলাম। লকডাউনের কারণে গাঁদা ফুলের গাছ ভেঙে দিয়েছি। মার্চ মাস থেকেই ফুলের কেনাবেচা বন্ধ হয়ে গেছে। লেবার নেওয়ার মতো অবস্থাও নেই। পরিচর্যার অভাবে খেত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’ যশোরের গদখালী এলাকায় যে ছয় হাজার ফুলচাষি রয়েছেন, তাদের সবার গল্পই এখন একই রকম। একই অবস্থা ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা জেলার আরও ছয় হাজার ফুলচাষির। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, ‘করোনার কারণে ১৮ মার্চ থেকে গদখালী ফুলের হাটে কেনাবেচা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। টাকার অঙ্কে এখন পর্যন্ত ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার মতো। লকডাউন পরিস্থিতি যত দিন থাকবে, ক্ষতির পরিমাণও বাড়তে থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘সাধারণত ট্রাকে বা পিকআপে করে গদখালী থেকে ঢাকায় ফুল পরিবহন করা হয়। এ ছাড়া অন্য জেলাগুলোতে ফুল পাঠানো হয় পরিবহন বাসের ছাদে। এসব পরিবহন এখন বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া ৬৪ জেলায় যেসব ব্যবসায়ী ফুল বিক্রি করেন, তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন দিবস উদযাপন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হচ্ছে না। সব মিলিয়ে ফুল সেক্টরের অবস্থা খুবই খারাপ।
মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন সেক্টরকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করার জন্য সরকার নানারকম প্রণোদনা দিচ্ছে। ফুলচাষিদের বাঁচাতে আমরাও কৃষিমন্ত্রী ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে আমাদের দাবি-দাওয়া পেশ করেছি। খাদ্য সহায়তা এবং সহজ শর্তে ঋণের মতো আর্থিক প্রণোদনা ফুল সেক্টরের জন্য খুবই জরুরি। এ জন্য এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার দাবি করেছি আমরা। তাছাড়া প্রণোদনা যাতে আসলেই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ীরা পান, সে বিষয়টি তদারক করতে একটি তদারকি কমিটি গঠনের ওপর জোর দিয়েছি আমরা। তা না হলে প্রণোদনার টাকা চলে যাবে অন্য জায়গায়।
তাছাড়া ফুলচাষিদের ৭০ শতাংশই অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ফুল চাষ করে থাকেন। এসব বর্গাচাষি যাতে প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত না হন, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।’ আবদুর রহিম বলেন, করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত যশোর অঞ্চলের ফুলচাষিদের মধ্যে ১৬৫৯ জনের একটি তালিকা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ৪০০ ফুলচাষিকে এ খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ফুলচাষিদের আপাতত টিকিয়ে রাখার জন্য খাদ্য সহায়তা আরও বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি তিনি শত কোটি টাকার সম্ভাবনাময় এ ফুল সেক্টরটি যাতে আবার জমজমাট হয়ে উঠতে পারে সে জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণও করেন।