সারাবিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে করোনা প্রকটে। ইরানের কোন এক কবরস্থান-সংলগ্ন মর্গ বা লাশ রাখার ঘরের ভেতরে মোবাইল ফোন দিয়ে তোলা সেই ভিডিওটি সারা পৃথিবীকে চমকে দিয়েছিল। তিনটি ঘরে শুধু লাশ আর লাশ।
কিছু মৃতদেহ সাদা কাফনের কাপড় জড়ানো। আর বাকিগুলো কালো বডি ব্যাগে ভরা, কবর দেয়ার জন্য প্রস্তুত করার আগে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে।
লাশঘরের কর্মী লোকটি বলছিলেন, সাদা কাফনে জড়ানো লাশগুলোর কাজ সকাল বেলাই \’সেরে ফেলা হয়েছে।\’
মধ্য ইরানের পবিত্র শহর কোমে এই ভিডিওটি তোলা হয়েছিল। এখান থেকেই দেশটিতে প্রথম করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করেছিল।
কর্মীটি আরও বলছেন, এখানে যাদের লাশ তারা সবাই করোনাভাইরাসে মারা গেছেন। অবশ্য বিবিসি তার বক্তব্য যাচাই করতে পারেনি। তবে সবচেয়ে মারাত্মক যে কথাটি তিনি ওই ভিডিওতে বলেছিলেন তা হলো – সেখানে এমন কিছু মৃতদেহ আছে যা গত পাঁচ-ছদিন ধরে মর্গে পড়ে আছে।
ফুটেজ এবং লোকটির মন্তব্য থেকে একটা বৃহত্তর সত্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আর তা হলো – এত বেশি মানুষ মারা যাচ্ছিল যে তা সামাল দিতে ইরান হিমশিম খাচ্ছিল, এবং মৃত্যুর সংখ্যা হয়তো যা স্বীকার করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
ওই ভিডিওটি মার্চের ২ তারিখ প্রকাশ পাবার পরই অনলাইনে ভাইরাল হয়।
আর ইরানী কর্তৃপক্ষ যেভাবে এই ভিডিওটির ব্যাপারে সাড়া দিয়েছিল তাতেও বোঝা যায়, মিডিয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ কিভাবে তুলে ধরা হচ্ছে – তা নিয়ন্ত্রণের জন্য তারা প্রাণপণে লড়াই করছিল।
ভিডিওটির পটভূমি
মধ্যপ্রাচ্যের আর কোন দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ইরানের মত এত মারাত্মক চেহারা নেয় নি।
ইরান থেকে কোন নির্ভুল তথ্য পাওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু অনলাইন পোস্টে আভাস পাওয়া যায় যে দেশটির মর্গগুলো মৃতদেহে ভরে গিয়েছিল।
একটা কারণ ছিল এই, মৃতদেহ ধোয়ার কাজ করেন যে পেশাদার লোকেরা – তারা নাকি নিজেরা সংক্রমিত হবার ভয়ে কোভিড-১৯এ মারা যাওয়া লোকদের লাশ পরিষ্কার করতে চান নি।
বাস্তবিক, ইরানের কিছু মর্গে ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী লাশ ধোয়ার কাজটা করেন স্বেচ্ছাসেবকরা – যারা অনেকেই ধর্মীয় স্কুলের ছাত্র।
মনে করা হয় যে লাশ থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়ায় না। তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মৃতদেহ নাড়াচাড়ার সময় অত্যন্ত সাবধান হবার পরামর্শ দিয়েছে, কারণ এ ভাইরাস সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা।
ইতালির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বলেন, লাশ থেকে ভাইরাস না ছড়ালেও কাপড়ের ওপর ভাইরাস বেঁচে থাকতে পারে। ইতালিতে তাই মৃতদেহ সাথে সাথেই ব্যাগে ভরে সীল করে ফেলা হয় এবং আত্মীয়স্বজনদেরকেও লাশ দেখতে দেয়া হয় না।
ইরানী কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া
মর্গে পড়ে থাকা মৃতদেহের দৃশ্য ভাইরাল হবার সাথে সাথেই ইরানের কট্টরপন্থীরা সক্রিয় হয়ে উঠলেন।
যে লোকটি সেই ভিডিওটি করেছিলেন, তাকে গ্রেফতার করা হলো।
এর পর কর্তৃপক্ষ জনগণকে আশ্বস্ত করতে লাগলেন যে সকল লাশের ক্ষেত্রেই ইসলামী রীতিনীতি অনুযায়ী সম্মানের সাথে যা করণীয় তা করা হচ্ছে।
শরিয়া আইন অনুযায়ী, মৃত্যুর পর দেহ কবর দিতে বেশি দেরি করা যাবে না। তার আগে পানি দিয়ে তিনবার লাশ পরিষ্কার করতে হবে – যাকে বলে গোসল-এ মেইয়েত।
আয়াতোল্লাহ খামেনির নির্দেশ
মার্চ মাসের শুরুতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনি ঘোষণা করলেন, কোভিড-১৯এ মৃত ব্যক্তিদের লাশ অন্য সবার মতোই পরিষ্কার করতে হবে, কাফনের কাপড় পরাতে হবে এবং কবর দেবার আগে নিয়মমত তার জানাজা হতে হবে।
ওই ফুটেজ দেখে লোকের মনে যে ক্রোধ ছড়িয়ে পড়েছিল তা শান্ত করতে কট্টরপন্থী ওয়েবসাইটগুলোয় কিছু মর্গ স্বেচ্ছাসেবকদের কার্যক্রম দেখানো শুরু হলো।
কোম শহরের একদল নারী স্বেচ্ছাসেবকের নামই হয়ে গেল “করোনা লেডিজ।“
তাদের তুলে ধরা হলো সাহসী নারী হিসেবে,- যারা নিজেরা স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে হলেও ভাইরাসে মৃতদের ইসলামী শেষকৃত্য নিশ্চিত করছেন।
দেখা যায়, সারা দিনে তিনটি দল সাত ঘন্টার শিফটে এই কাজ করছেন, আর কাজের মাঝে মাঝে ধর্মীয় আয়াত বলে শ্লোগান দিচ্ছেন।
তারা বলেন, কমবয়স্ক কারো মৃতদেহ পরিষ্কার করার সময় তারা মনোবল চাঙ্গা রাখতে আরো জোরে জোরে শ্লোগান দেন।
তাদের পিঠে লেখা শ্লোগানে বলা হচ্ছে. “আপনার যদি সিংহের মত সাহস না থাকে তাহলে আপনি ভালোবাসার পথে এগুতে পারবেন না। “
কিন্তু ইরানের হাসপাতালগুলো যখন ভরে গেছে, আর মর্গগুলো লাশের চাপ সামলাতে পারছে না, – তখন সরকারকে এই অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে – সংকট কি আসলে সরকার যা বলছে তার চেয়েও গুরুতর?
ইরানে সংক্রমণ কত গুরুতর?
এক সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয়, ইরানে ৬০ হাজারেরও বেশি লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৪ হাজার লোকের।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ইরানী গবেষকদের একটি দল মনে করেন – প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
ইরানে সংকটের প্রকৃত চিত্র হয়তো কখনোই জানা যাবে না।
দেশটিতে বহু লাশের ঠাঁই হয়েছে গণকবরে – যা পৃথিবীর এ অংশে কখনো ঘটতে শোনা যায় না।
উত্তর ইরানের মাজানদারান অঞ্চলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডাক্তার বলেছেন, কিছু ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গিয়ে চুন দিয়ে কবর ঢেকে দেবার কাজ তদারকি করেছেন – যাতে সংক্রমণ এবং ভাইরাসের বিস্তার ঠেকানো যায়।
ডাক্তারটি বলেন, মৃত্যুর কারণ হিসেবে হৃদরোগ বা ফ্লু –র কথা ডেথ সার্টিফিকেটে বলা হলেও এই বিশেষজ্ঞদের পাঠানোতে বোঝা যায় – আসলে এসব মৃত্যুর কারণ ছিল কোভিড-১৯।
বেশ কিছু পরিবার অভিযোগ করেছে যে তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহের কী হয়েছে – তা নিয়ে তাদের কোন তথ্য জানানো হয় নি। বলা হয়েছে, সংকট পার হলে তাদের এ ব্যাপারে জানানো হবে।
তবে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা আশ্বাস দিচ্ছেন যে তাদের স্বজনদের লাশ সম্মানের সাথে যথাযথ ইসলামী রীতিনিত মেনেই কবর দেয়া হচ্ছে।