ফ্রুট ব্যাগিং: আমদানি ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন দেশে

বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু ফল আবাদের জন্য উপযোগী। বর্তমানে সারাদেশে ১৩০ প্রজাতির ফলের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি বছর ৭০ প্রজাতির প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের আবাদ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হচ্ছে। তাছাড়া ফল একটি অর্থকরী ফসল। নিরাপদ ও বিষমুক্ত ফল খেতে কে না চাই। আর খাদ্যের নিরাপত্তা ঠিক থাকলে দাম নিয়েও ভোক্তার কোনো সমস্যা থাকে না। এ কারণেই গত ৬ বছরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আমের ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি। পদ্ধতিটি নিরাপদ হওয়ায় বিদেশেও চাহিদা বাড়তে থাকে। কিন্তু কিছু সমস্যা ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে সম্ভাবনাময় এ পদ্ধতিটির জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ পদ্ধতির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয় ২০১৫ সালে। প্রথম দিকে চাষিরা তেমন একটা আগ্রহী না হলেও ২০১৬ সালে বাণিজ্যিকভাবে এ পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হলে পরের বছর বাড়তে থাকে এ পদ্ধতিতে আমচাষ। কীটনাশকের প্রয়োগ একেবারেই কম থাকায় এবং ফ্রুট ব্যাগিং করা আম স্বাদ ও গুণে অটুট থাকায় এ আম দেশের সীমানা ছাড়িয়ে রপ্তানি হতে থাকে ইউরোপের দেশগুলোতে।

এ ব্যাগিং পদ্ধতি যখন চাষিদের দেখাচ্ছে নতুন স্বপ্ন তখনই কিছু সমস্যা ও কিছু ব্যবসায়ীর প্রতারণার কারণে পদ্ধতিটি থেকে মুখ ফেরাতে আরম্ভ করেছে আম চাষিরা। আম গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানী জমির উদ্দিন জানান, আমের মুকুল আসার পর ৩৫-৪০ দিন বয়সের আম হলেই সে আমে ব্যাগিং করা যায়। তবে এরপরেও ব্যাগিং করা যায়। এছাড়া ব্যাগিং করার আগেই মরা মুকুল বা পুষ্পমঞ্জুরির অংশবিশেষ, পত্র, উপপত্র ছিড়ে ফেলতে হয় এবং কাজটি করার সময় আমটি ব্যাগের মাঝ বরাবর রাখতে হবে। আর ব্যাগের শীর্ষ প্রান্ত এমনভাবে মুড়িয়ে দিতে হবে যেন পানি বা অন্যকিছু ভেতরে না ঢুকতে পারে। নন ব্যাগিং আমে ১৫ থেকে ৬২ বার বালাইনাশক দেওয়া হলেও এ পদ্ধতিতে আমে সর্ব্বোচ্চ ৪ বার বালাই নাশক প্রয়োগ করতে হয়।

এতে করে আম বিষমুক্ত এবং রোগবালাই, বাইরের প্রখর সূর্যালোক ও পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়া। ফ্রুট ব্যাগিং করা আম দীর্ঘদিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়।
Fruit bagging

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে বর্তমানে ১০-১২ প্রকার ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে যেগুলোর কোনটি মানহীন আর কোনটি ভাল তা নিয়ে দিধায় কৃষক। এমনকি ব্যবসায়ীরাও অনেক সময় ব্যাগের মান নিয়ে থাকেন সংশয়ে। তাছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম গাছগুলো আকারে বড় ও উঁচু হওয়ায় সবগুলো আমও ব্যাগিং করা যায়না। এতে করে বাকি আমগুলো পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে বালাইনাশক প্রয়োগ করতে বাধ্য হন চাষিরা। পাশাপাশি শ্রমিক সংকট ও ব্যাগিং করার খরচও দিন দিন বাড়ার কারণে অনেক আমচাষির ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও ও ব্যাগিং করতে পারেন না। অন্যদিকে কিছু কিছু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে ব্যাগের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বিপাকে ফেলছেন চাষিদের। এতে করে পদ্ধতিটির জনপ্রিয়তা হোঁচট খাচ্ছে। বর্তমানে চীন থেকে সরাসরি এ বিশেষ ব্যাগ আমদানি হচ্ছে। আবার জেলায় গড়ে ওঠা একটি প্রতিষ্ঠানও স্থানীয়ভাবে ব্যাগ তৈরি করছে। শিবগঞ্জের সেলিমাবাদ গ্রামের কৃষক নিয়ামত খান জানান, গতবছর শ্রমিকদের অনভিজ্ঞতার কারণে ব্যাগিং করা আমে বর্ষায় পানি ঢুকে অনেক আম পচে গেছে। আর এ বছর শ্রমিক সংকট। তাই তিনি এ বছর তার কোনো বাগানই ব্যাগিং করেননি।

কানসাটের কৃষক মহি মিজান জানান, প্রয়োজনের সময় ব্যাগ পাওয়া যায়না। আবার দামও ব্যাগ প্রতি গত বছরের থেকে বেড়েছে ২ টাকা করে। তাই তিনি এবার তার মোট বাগানের অর্ধেক বাগানের আম ব্যাগিং করেছেন।

চককীর্ত্তির অপর কৃষক জানান, বাজারে হরেক রকম মানহীন ব্যাগ বের হওয়ায় তারা ব্যাগের গুনাগুন নিয়ে চিন্তিত। সেসঙ্গে দাম বৃদ্ধি ও শ্রমিকের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি তো আছেই।

ব্যাগ বিক্রেতা জাহাঙ্গির বিশ্বাস জানান, বাজারে ১০-১২ প্রকারের ব্যাগ বের হওয়ায় এবং চাহিদা অনুযায়ী তারা ব্যাগ সরবরাহ না পাওয়ায় ব্যাগ বিক্রিতে সমস্যায় পড়ছেন।

অপর ব্যাগ বিক্রেতা ইসমাইল খান শামিমও ব্যাগের গুনগত মান নিয়ে ক্ষুদ্ধ। তার দাবি ব্যাগ আমদানি ও বাজারজাতকরনে প্রশাসনের নজরদারি প্রয়োজন। জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এ পদ্ধতির জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হলে ব্যাগ আমদানি ও বিক্রির জন্য সুনির্দ্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম ব্যাগের গুনগত মানের সমস্যাটি স্বীকার করে বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই বিষয়টি বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের নজরে এনেছি। আশা করা হচ্ছে দ্রুতই মাননিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় কৃষি বিভাগ একটি নীতিমালা তৈরি করবে।

এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ১০ কোটি আমে ব্যাগিং করা হয়েছে।