অশনি সংকেত: হিমবাহই থাকবে না আগামী শতাব্দীতে

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হিমালয় গলে যাচ্ছে। গত ৫৫ বছরে সাড়ে ৯ লাখ কোটি টনেরও বেশি (৯ হাজার ৬২৫ গিগাটন) বরফ গলে গেছে বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তের হিমবাহের। গবেষণা জানিয়েছে, উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গোটা বিশ্বের হিমবাহগুলো যে হারে গলতে শুরু করেছে, বিশেষ করে, গত ৩০ বছর ধরে, তাতে আগামী শতাব্দীতে পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই আর কোনো হিমবাহ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন অশনি সংকেত দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

আরো উদ্বেগজনক খবর, সিন্ধু ও গঙ্গোত্রীর মতো হিমালয়ের বিশাল বিশাল হিমবাহগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিই গলে গিয়ে তৈরি করছে সুবিশাল হ্রদ। যা লাগোয়া এলাকাগুলোতে বিধ্বংসী বন্যার আশঙ্কাকে জোরালো করে তুলেছে। ভয়াবহ অবস্থা ভারত, নেপাল, চীনসহ দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর প্রত্যেকটি বড় হিমবাহের। সবারই বরফ গলে যাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত হারে।

এই উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে একটি আন্তর্জাতিক গবেষক দল। যাদের আলোড়ন ফেলা গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এ। গত ৮ এপ্রিল সংখ্যায়।

সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক মাইকেল জেম্প ও ফ্র্যাঙ্ক পলের নেতৃত্বাধীন ওই আন্তর্জাতিক গবেষক দলে রয়েছেন ভারতীয় দুই বিজ্ঞানীও। একজন জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্ঘ্য মিত্র। অন্যজন জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অর্জুন বেঙ্কটেশ্বরন।

গবেষণাটি চালানো হয়েছে ১৯৬১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সব প্রান্তে যত বড় বড় হিমবাহ রয়েছে, গত ৫৫ বছর ধরে তার সবক’টির ওপর নজর রেখে চলা উপগ্রহগুলোর পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে।

জুরিখ থেকে অন্যতম গবেষক অধ্যাপক অর্ঘ্য মিত্র লিখেছেন, আমরা দেখেছি, এটা শুধুমাত্র বিশেষ কোনো অঞ্চলের সমস্যা নয়। গোটা বিশ্বেই গত ৫৫ বছরে বড় বড় হিমবাহগুলো অত্যন্ত দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে। উপগ্রহগুলোর পাঠানো তথ্যাদি জানিয়েছে, হিমবাহগুলো সবচেয়ে বেশি দ্রুত হারে গলছে আলাস্কায়। তার পরেই রয়েছে গ্রিনল্যান্ড। সেখানকার পুরু, সুবিশাল বরফের চাঙরগুলোর ধার থেকে যে বিশাল বিশাল হিমবাহের জন্ম, সেগুলো খুব দ্রুত হারে গলে গেছে গত অর্ধশতাব্দীতে। অত্যন্ত দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে আন্দিজ পর্বতমালার দক্ষিণ দিক থেকে বেরিয়ে আসা হিমবাহগুলোও। এছাড়াও, হিমবাহের বরফ খুব দ্রুত হারে গলছে কানাডা ও রাশিয়ার আর্কটিক এলাকায়, স্বালবার্ডেও। আর ওই সবক’টি অঞ্চলের গলে যাওয়া হিমবাহই সাগর ও মহাসাগরগুলোর জলস্তর উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।

সুবিশাল হিমবাহ রয়েছে, বিশ্বের এমন ১৯টি অঞ্চলের ওপর চালানো ওই গবেষণা এ-ও জানিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে একমাত্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুবিশাল হিমবাহগুলোতেই গত অর্ধশতাব্দীতে বরফের পরিমাণ বেড়েছে। আর বরফের পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে অত্যন্ত দ্রুত হারে কমেছে হিমবাহ প্রধান ১৭টি অঞ্চলে। এরই মধ্যে যা সমুদ্রের জলস্তরকে ঠেলে ওপরে তুলে দিয়েছে অন্তত ২৭ মিলিমিটার।

পুণের ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যান্টার্কটিক অ্যান্ড ওশন রিসার্চের (এনসিএওআর) অধিকর্তা এম রবিচন্দ্রন জানিয়েছেন, এই গবেষণার সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় দিকটা হলো গত অর্ধশতাব্দীতে যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবক’টি হিমবাহের মোট বরফ গলেছে ১১২ গিগাটনেরও বেশি, তখন দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ হিমবাহে বরফের পরিমাণ মোট বেড়েছে ১১৯ গিগাটন (এর গিগাটন বলতে বোঝায় ১ লাখ কোটি টন)।

অর্ঘ্যরে কথায়, উষ্ণায়নের প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম পড়েছে যে সব এলাকায়, সেই ইউরোপের দিকে থাকা আল্পস পর্বতমালা ও ককেশাস পর্বতমালারও প্রায় সবক’টি হিমবাহই খুব দ্রুত হারে গলে গেছে গত ৫৫ বছরে। তবে তা সাগর, মহাসাগরের জলস্তরের উচ্চতা বাড়াতে ততটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়নি।

গবেষণা চালানো হয়েছে বিশ্বের মোট ১৯ হাজার হিমবাহের ওপর। মূল গবেষক মাইকেল জেম্প বলেছেন, ‘বিশ্বে এক বছরে গড়ে ৩৩ হাজার ৫০০ কোটি টন করে বরফ গলে যাচ্ছে হিমবাহগুলোর। ফলে সাগর, মহাসাগরের জলস্তর ওপরে উঠছে বছরে গড়ে ১ মিলিমিটার করে। সমুদ্রের জলস্তর ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে গত ৩০ বছরে।

বিশিষ্ট হিমবাহ বিশেষজ্ঞ এম রবিচন্দ্রন জানাচ্ছেন, এতে আর কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বের কয়েকটি দেশের বড় ও মাঝারি সব হিমবাহই গলে পানি হয়ে যাবে। 

Scroll to Top