রাত যেন শেষ হওয়ার নয়। সবার নির্ঘুম প্রতীক্ষা একটি ঘোষণার জন্য। বিশেষ করে সারাদিন নানা নাটকীয়তা এবং উত্তেজনার পর ডাকসু নির্বাচনে কারা নেতৃত্বে আসছেন, তা জানতে অধীর ছিলেন সাধারণ মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে যেমন, তেমনি প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের সংবাদকক্ষেও সাংবাদিকরা বসেছিলেন সেই চূড়ান্ত খবরটি দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তবে রাত যত গভীর হয়, ততই বাড়তে থাকে নাটকীয়তা।
এর মধ্যে রাত সাড়ে ১২টার মধ্যেই ১৮টি হল সংসদের নির্বাচনের খবর চলে আসে। দেখা যায়, ছাত্রদের হলগুলোতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের একচেটিয়া বিজয়। কিন্তু পাঁচটা ছাত্রী হলের তিনটিতে একেবারেই ভরাডুবি। সবমিলিয়ে ১৮টি হলের মধ্যে ১২টিতে ভিপি পদে এবং ১৪টিতে জিএস পদে জয়ী হয় ছাত্রলীগ প্রার্থীরা। আর ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ছয়টি হলে ভিপি পদে এবং চারটি হলে জিএস পদে জয় পায়। হল সংসদগুলোর ফল প্রকাশিত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুতেও ছাত্রলীগের বিপুল বিজয়ের খবরই আসছে, তা মোটামুটি
নিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্তু রাত ১২টার পর থেকেই খবর আসতে থাকে, ভিপি পদে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নুর এগিয়ে আছেন। এরপর ফলাফল ঘোষণা না হলে এক ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। ক্যাম্পাসে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে (নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট হল) ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছাড়া আর কোনো প্যানেলের নেতাকর্মীরা থাকেননি। তবে মাঝখানে সিনেট হলের বাইরে কিছু শিক্ষার্থীকে দেখা যায় নুরুল হক নুরের পক্ষে স্লোগান দিতে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তারা চলে যায়।
এরপর শুধুই প্রতীক্ষা আর জল্পনা-কল্পনা। অবশেষে রাত সোয়া ৩টায় পদাধিকার বলে ডাকসুর সভাপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর আব্দুস সামাদ এবং প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক এস এম মাহফুজুর রহমানসহ সিনেট হলে প্রবেশ করেন। প্রথমে উপাচার্য জানান, ডাকসুর গঠনতন্ত্রের ১৮(অ) ধারায় প্রদত্ত বিধান বলে তিনি ফলাফল ঘোষণা করছেন। ফলাফল ঘোষণার আগে তিনি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা শিক্ষক এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। এর পরই তিনি ঘোষণা করেন, ভিপি পদে নুরুল হক নুর ১১ হাজার ৬২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ছাত্রলীগ নেতারা \’ভুয়া ভুয়া\’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। তাদের শোরগোলে কিছু সময়ের জন্য ফলাফল না ঘোষণা করে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন উপাচার্য। এ সময় ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন সবাইকে শান্ত হতে বলেন। কিন্তু উচ্চৈঃস্বরে কিছু একটা বলতে থাকেন ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। পরে শোরগোল কিছুটা থামলে উপাচার্য বাকি ফলাফল ঘোষণা করেন। এতে ভিপি এবং সমাজসেবা সম্পাদক পদ ছাড়া ২৫টির মধ্যে ২৩টি পদেই জয়ী হয় ছাত্রলীগের প্রার্থীরা।
পুরো ফলাফল ঘোষণার পর উপাচার্যকে ঘিরে ধরেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। তারা ভিপি পদে ফলাফল মানি না বলে স্লোগান দেন। একপর্যায়ে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ভিড় ঠেলে সামনে এসে উপাচার্যকে ভিপি পদে ফলাফল পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানান। এরপর তিনি নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন, \’তিনি প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র রাজনীতি করেন। এর আগে তিনি শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করে কোটা সংস্কার, সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনের নামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন। নির্বাচনের দিন রোকেয়া হলে ব্যালট ছিনতাইয়ের জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাই তাকে বহিস্কার করতে হবে।\’
এর জবাবে উপাচার্য এ বিষয়গুলো নিয়ে পরে আলোচনার অনুরোধ জানিয়ে এ মুহূর্তে তাকে বাসায় যেতে দেওয়ার অনুরোধ জানান। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ বোধ করছেন বলেও জানান। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ভিসির পথ অবরুদ্ধ করে স্লোগান দিতে থাকেন। কয়েকজনকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, \’এ ডাকসু চাই না।\’ এর প্রায় আট-দশ মিনিট পর তারা কিছুটা শান্ত হলে উপাচার্য অন্যদের সঙ্গে নিয়ে চলে যান।
এরপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা উপাচার্যের বাসার সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত স্লোগান চলার পর একপর্যায়ে অনেকেই চলে যান। তবে সকাল ৯টায় আবারও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। সূত্র- সমকাল