বার্ন ইউনিটের দেয়ালে দেয়ালে ভালোবাসা

শুক্রবার বেলা ৩টা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড। প্রথম দর্শনেই যে কারও নজর চলে যাবে প্রবেশমুখের দেয়ালে। সাদা কাগজে নাম, রক্তের গ্রুপ আর মোবাইল ফোন নম্বর লিখে সাঁটিয়ে রাখা। একটি-দুটি নয়, শত শত। অনেক তরুণ-তরুণী সেখানেই অপেক্ষা করছেন। সবাই রক্ত দিতে চান চুড়িহাট্টায় দগ্ধদের।

স্বজন না হয়েও সহমর্মিতা, আবেগ আর বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে ছুটে এসেছেন তারা। ইটপাথরের এ নগরে যেন বয়ে গেল এক টুকরো ভালোবাসার প্রহর। এ যেন এক মানবিক বাংলাদেশ। চিকিৎসকরা বলছেন, মানুষ যেভাবে সাড়া দিয়েছে তাতে রক্তের কোনো অভাব হচ্ছে না।

প্রয়োজন অনুযায়ী সব গ্রুপের পর্যাপ্ত রক্ত পাওয়া যাচ্ছে। বই হাতে দাঁড়িয়ে জুনায়েদ আহমেদ। সঙ্গে তার সহপাঠী সেতু। দুজনই এসেছেন খিলগাঁও থেকে। খিলগাঁও মডেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এ দুই শিক্ষার্থীই রক্ত দিতে চান। জানতে চাইলে সেতু বলেন, ‘অনেক দূর থেকে এসেছি। একসঙ্গে অনেক মানুষ দগ্ধ হয়েছেন, অনেক রক্ত দরকার। ভাবলাম রক্তের জন্য যেন কারও সমস্যা না হয়, সে জন্য আসা।’ সেতুর সহপাঠী জুনায়েদ বললেন, ‘আমরা নিয়মিত রক্ত দেই। সাধারণত কারও রক্ত লাগলে আমাদের তারা ফোন করেন। তবে এখানে আমরা উল্টো ছুটে এসেছি।

এমন নির্মম ঘটনার পর বাসায় বসে থাকা যায়?’ বার্ন ইউনিটজুড়ে এ দুই বন্ধুর মতো শত শত তরুণের আনাগোনা। মিরপুর থেকে ছুটে এসেছেন তিন বন্ধু, সরকারি বাঙলা কলেজের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র আবদুস সালাম, ঢাকা কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের দারুস সালাম শিশির, মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ফিন্যান্স বিভাগের মিজান। তিন জনের বাড়িই দিনাজপুরে। দেয়ালে দেয়ালে রক্তদাতাদের নাম লেখা দেখে তারাও সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেদের নাম-ঠিকানা আর রক্তের গ্রুপ লিখে যাবেন। আরেক জনের কাছ থেকে কাগজ-কলম নিয়ে লিখে তা টাঙিয়েও দিলেন।

দারুস সালাম শিশির বলেন, ‘মানবিক তাড়না থেকে ছুটে এসেছি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি রক্ত দিতে। বলল, আপতত লাগবে না। পরে যদি লাগে তাই নাম-ঠিকানা লিখে দিয়ে গেলাম। ফোন দিলেই চলে আসব।’ অপরিচিত শত শত তরুণের এমন ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে পড়েন বার্ন ইউনিটে উপস্থিত দগ্ধদের আত্মীয়স্বজন। তারা জানান, কে বলে মানুষ মানুষের জন্য নয়? এখনো ভালো মানুষ আছেন, ভালোবাসার দেবদূত আছেন।

শুধু কী এই তরুণেরা? পিছিয়ে নেই বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক, নার্স, এমনকী নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরাও। পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের গেটে দায়িত্বরত আনসার সদস্য সায়মন মোল্লা দগ্ধ রোগীদের স্বজনদের বলছিলেন, ‘আপনারা আপনাদের প্রিয়জনকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে চান, নাকি বিপদের দিকে ঠেলে দিতে চান?’ রাজ্যের প্রশ্ন নিয়ে তার দিকে তাকালেন স্বজনরা। আর তখনই তিনি বুঝিয়ে বললেন, ‘ওয়ার্ডের ভেতরে যত যাবেন, আপনাদের স্বজনরা তত বেশি সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়বেন।’ উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের কাছেও এ বার্তা দিচ্ছিলেন সায়মন মোল্লা।

চিকিৎসকরাও জানালেন, চকবাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নয় জন দগ্ধ বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। তবে দগ্ধ রোগীদের প্রধান শত্রু হলো সংক্রমণ। আর তা ছড়াতে পারে বাইরের লোকজনের মাধ্যমে। তাই প্রয়োজন ছাড়া রোগী দেখতে ভিড় না করার পরামর্শ তাদের। সব ধরনের চিকিৎসা সহায়তা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান চিকিৎসকরা।

এ বিষয়ে বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘রক্ত দিতে আসা মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। এটি অবশ্যই সহযোগিতার অনন্য উদাহরণ।’ এ ছাড়া রক্তদাতাদের সংগঠন সন্ধানীকেও রক্তের ব্যাপারে জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি। গত বুধবার রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে দগ্ধ নয় জন ঢামেক বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন কয়েক জন।

Scroll to Top