আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে বড় বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকায় এই নির্বাচন জৌলুস হারাতে বসেছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনের ‘আলোচিত’ কমিশনার মাহবুব তালুকদার।
মঙ্গলবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সকালে নির্বাচন ভবনে উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপের রিটার্নিং অফিসার ও সহকারি রিটার্নিং অফিসারদের ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় পর্যায়ে আয়োজিত এই কর্মশালায় এসে আমার মনে একটি প্রশ্ন জেগেছে, আমরা নির্বাচন কেন করি? এর উত্তর অত্যন্ত সহজ- গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। গণতন্ত্র কি? এ প্রশ্নের উত্তরও কঠিন নয়। গণতন্ত্র হচ্ছে ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের বেছে নেয়া এবং তাদের দিয়ে জাতীয় বা স্থানীয় পর্যায়ে দেশ পরিচালনা। জাতীয় পর্যায়ের মতো স্থানীয় পর্যায়েও গণতন্ত্র একটি সুনির্দিষ্ট অবকাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বিশেষ কোনো আদেশ-নির্দেশে যদি সেই অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাহলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েন। এই অবস্থা কখনই কাম্য নয়। কিন্তু বর্তমানে উপজেলা পরিষদ যেভাবে দায়িত্ব পালন করার কথা তা সম্ভব হচ্ছে না। আমি আগেও বলেছি, উপজেলা পরিষদ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না হলে এর নির্বাচনও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই তো নির্বাচন। নির্বাচন কখনো গণতন্ত্রহীনতাকে প্রশ্রয় দিতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘এবারের উপজেলা নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকছে। এতে এই নির্বাচন জৌলুস হারাতে বসেছে। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, নির্বাচনকে অবশ্যই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। আগামী উপজেলা নির্বাচন সার্বিকভাবে অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না, এই সত্যকে মেনে নিয়েই নির্বাচন করতে হবে। ধারণা করা যায়, চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রায় প্রত্যেকেই নির্বাচিত হবেন এবং ঐ পদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না, এটাই বাস্তবতা। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য শব্দ দুটির ঔজ্বল্য থাকে না। তারপরও আনুষ্ঠানিকতার কারণেই নির্বাচন করে যেতে হয়। আমি মনে করি, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, নির্বাচনের মৌলিক কাঠামো যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, সেদিকে সর্তক থাকতে হবে। নির্বাচনের মৌলিক কাঠামো বলতে সংবিধান ও আচরণবিধিমালায় বর্ণিত সংশ্লিষ্ট সকলের দায়-দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পরিপালনের নির্দেশ মান্য করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে চেয়েছি।’
বিভিন্ন সময় আলোচনায় আসা এই কমিশরার আরও বলেন, ‘গতকাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আলোচনায় আমি বলেছি যে, আইন ও শৃঙ্খলা এই দুটি শব্দের মধ্যেই নির্বাচনের মূল দর্শনটি নিহিত রয়েছে। নির্বাচন অবশ্যই আইনানুগ হতে হবে। আইনানুগ হওয়ার অর্থ সবার প্রতি সম-আচরণ ও সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করা, এছাড়া আইনের অন্য কোনো ব্যাখ্যা নেই। অন্যদিকে শৃঙ্খলার অর্থ নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে সম্পন্ন করা। আইন ও শৃঙ্খলা কথাগুলোর সঙ্গে নির্বাচনে আচরণবিধি পরিপালনের বিষয়টি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করে কঠোরভাবে আচরণবিধি প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচনকে সার্বিকভাবে সাফল্যমণ্ডিত করা সম্ভব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলতে আমরা যাদের বুঝি, কেবল তারা নয়, আপনাদের হাতেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মূল কর্তৃত্ব বর্তায়।’
তিনি বলেন, ‘আমি এতক্ষণ যা কিছু বলেছি, তা কিছুটা তাত্ত্বিক। এবার নির্বাচনের ব্যবহারিক দিক নিয়ে কথা বলতে চাই। তবে এই ব্যবহারিক বিষয়ের কথা অনেকটা চর্বিত চর্বন মনে হতে পারে। এ ধরনের কর্মশালায় আমরা সাধারণত যে কথাগুলো বলে থাকি, তা হলো- নির্বাচন আইনানুগ হতে হবে, ভোটারগণ যাতে নিবিঘ্নে ভোট দিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে, রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের দায়িত্বপালনে কোনো শিথিলতা সহ্য করা হবে না, আমরা প্রশ্নবিদ্ধ কোনো নির্বাচন করতে চাই না, নির্বাচনে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে আপনাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে- মোটামুটি এসব কথাই ঘুরে ফিরে আমরা বলে থাকি। যেহেতু আপনারা প্রায় প্রত্যেকেই ইতোপূর্বে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছেন, সেহেতু এসব বক্তব্যের সঙ্গে আপনারা পূর্ব পরিচিত। তবু কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে হয়। ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়তাম, সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়। বারবার পড়ে কথাটি মুখস্থ করেছি। কেন মুখস্থ করেছি জানি না। কিন্তু বারবার পাঠ করেও তা মনস্থ হয়নি। আপনারাও হয়ত আমাদের নির্দেশাবলি মুখস্থ করে ফেলেছেন। কিন্তু কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে, বিষয়সমূহ আপনাদের মনস্থ করার জন্য। আপনারা আমাদের বক্তব্য মনস্থ করলে বা হৃদয়ঙ্গম করলে কথাগুলো আর চর্বিত চর্বন মনে হবে না।’
মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘এবারে ভোটারদের কথায় আসি। আমার মনে হয়, নির্বাচনে যারা ভোটার, বিশেষত উপজেলা নির্বাচনে যারা ভোটার, তাদের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত না হলে এবং কার্যত ভোটারদের নিরাপত্তা বিধান করা না গেলে তারা ভোটকেন্দ্রে আসতে উৎসাহিত হন না। নির্বাচনে ভোটারদের প্রাধান্য ও ভোটদানের স্বাভাবিকতার ওপরই নির্বাচনের সাফল্য নির্ভরশীল। উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীরা যাতে ভোটারদের নিরিক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা প্রমাণ করে তাদের পদে আসীন হন, সেটাই প্রত্যাশা। কেউ অবঞ্ছিত উপায়ে নির্বাচিত হওয়ার চেষ্ঠা করলে তিনি নিশ্চিয়ই যোগ্য নন বা যোগ্যতা হারিয়েছেন। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সকলের কাছে একটাই চাওয়া আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের আকাঙ্খাই যেন প্রতিফলিত হয়।’
তিনি বলেন, ‘আর কয়েকদিন পর আমাদের স্বাধীনতার মাস শুরু হবে। স্বাধীনতা স্বপ্ন ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। নির্বাচন ব্যতিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে গণতন্ত্রও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। প্রশ্নবিদ্ধ গণতন্ত্র নিয়ে কোনো জাতি বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদা নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের দামে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে আমরা গণতন্ত্র সমুন্নত রেখে পথ চলতে চাই। এজন্যই নির্বাচনকে জাতির আশা-আকাঙ্খার পরিপূরক বলে আমি মনে করি। সুষ্ঠু নির্বাচন আমাদের দেশ প্রেমের অভিব্যক্তি।’
কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে এই কমিশরার বলেন, ‘কর্মশালার মধ্য দিয়ে প্রতিটি বিষয়ে সামগ্রিক জ্ঞান অর্জন আপনাদের দুদিক থেকে সমৃদ্ধ করবে। প্রথমত, আপনাদের অধিত বিদ্যা এই কর্মশালায় শানিত হবে এবং অন্যদিকে নির্বাচনের আচরণবিধি ও বিধি-বিধান সম্পর্কে আপনাদের আহরিত জ্ঞান দায়িত্বপালনের ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দেবে। আত্মবিশ্বাস না থাকলে কোনো কর্তব্য পালনই সুসম্পন্ন হতে পারে না।’
মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের পরে দেশব্যাপী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের গুরুত্ব কম নয়। বিভিন্ন কারণে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। এমতাবস্থায়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে অন্তত আমরা যদি সমুন্নত রাখতে পারি, তাহলে দেশের মানুষের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে পারে। এই কাজে আপনাদের অবদান অনস্বীকার্য। আমি পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে আপনাদের সাফল্য কামনা করি।’