সেদিন ভয়ে শিউরে উঠেছিল মানুষ

নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় ভয়ে শিউরে উঠেছিল গোটা দেশের মানুষ। শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞে। একসঙ্গে সাতটি মানুষকে অপহরণের পর ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে লাশ গুমের ঘটনায় সেদিন হতবিহ্বল হয়ে পড়ে সবাই। আঁৎকে ওঠে শীতলক্ষ্যা নদীতে একের পর এক লাশ ভেসে উঠতে দেখে। নারায়ণগঞ্জ হয়ে ওঠে আতঙ্ক ও কান্নার শহর। বিশেষ করে র‌্যাব-১১ এর তৎকালীন অধিনায়ক তারেক সাঈদের নির্দেশে পুরো হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ায় এবং র‌্যাবের অন্যান্য সদস্যরা জড়িত থাকায় চরম আস্থাহীনতা দেখা দেয় এই সংস্থার প্রতি। ঘটনাটি ব্যাপক আলোড়ন তোলে দেশের বাইরেও।

নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নামে মানুষ। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সবাই। জড়িতদের বিচারের দাবি জোরালো হয়। প্রভাবশালী মহল ঘটনায় জড়িত থাকায় বিচার নিয়ে দেখা দেয় শঙ্কা ও উদ্বেগ। শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন হয় বিচারকাজ।
গতকাল সাত খুনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায় দেন উচ্চ আদালত। নারায়ণগঞ্জ জজ আদালতে যে ২৬ আসামিকে দেওয়া মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে ১১ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। এই রায়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার দাপটে প্রভাবশালীদের অপরাধ বিভিন্ন সময়ে মাফ হয়ে যাওয়ার প্রচলিত ধারনাও ভুল প্রমাণিত হলো। সেই সঙ্গে একসঙ্গে এত মানুষকে অপহরণ, হত্যা ও গুমের মতো ভয়ংকর অপরাধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এত বিপুলসংখ্যক সদস্যের একযোগে জড়িত হওয়া এবং মৃত্যুদন্ডের রায়ের মধ্য দিয়ে তৈরি হলো নজিরবিহীন রায়ের দৃষ্টান্ত।

কী ঘটেছিল সেদিন : ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডের নামাপাড়া এলাকায় র‌্যাবের সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে কাউন্সিলর নজরুলের গাড়ি থামায়। র‌্যাব গাড়ি থেকে নজরুল, তার তিন সহযোগী ও গাড়িচালককে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। তিনি অপহরণের বিষয়টি দেখে ফেলায় তাকে ও তার গাড়িচালককেও র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়। পরে তাদের সবাইকে হত্যা করে ওই রাতেই পেট কেটে এবং ইটের বস্তা বেঁধে সবার লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেয়। ৩০ এপ্রিল ছয়জন ও পরদিন একজনের লাশ ভেসে ওঠে। হত্যাকান্ডের শিকার অন্যরা হলেনÑ নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম। সব লাশের পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন। প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অপহরণের ঘটনায় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার; ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সব এসআইকে অন্য জেলায় বদলি করা হয়।

এর এক সপ্তাহের মধ্যে এ ঘটনায় র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যুক্ত থাকার তথ্য প্রকাশ পায়, টাকার বিনিময়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। একসঙ্গে সাতজনকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা ও গুমের নৃশংসতায় শিউরে ওঠে মানুষ। তারেক সাঈদ ত্রাণ ও দুর্যোগমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা হওয়ায় বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পায়। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা আন্দোলনে নামেন। সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করে নজরুলের অনুসারীরা ও এলাকাবাসী। উত্তেজিত জনতা ১ মে সকালে কাউন্সিলর নূর হোসেনের কার্যালয়; রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হাজি মো. ইয়াসিনের বাড়ি ভাঙচুর করে ও সংলগ্ন কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। গণমাধ্যমে ও সারা দেশে বিষয়টি হয়ে ওঠে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু।
দুটি মামলা : সাত খুনের ঘটনায় দুটি মামলা হয়। কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বাদী হয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা (পরে বহিষ্কৃত) নূর হোসেনসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা করেন। আর আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম হত্যার ঘটনায় একই থানায় আরেকটি মামলা হয়। এই মামলার বাদী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে পুলিশ।

র‌্যাবের সম্পৃক্ততা : ২০১৪ সালের ৪ মে নজরুলের শ্বশুর অভিযোগ করেন, র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম এম রানা ও মেজর আরিফ হোসেন ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে এ সাতজনকে অপহরণের পর খুন করেন। সেনা কর্মকর্তা তারেক সাঈদ ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা। তিনি র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক ছিলেন। নৌবাহিনীর কর্মকর্তা রানা ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আরিফও র‌্যাব-১১ এ ছিলেন। ১১ মে নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, সদস?্য মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ও চন্দনের জামাতা বিজয় কুমার পালের রিট আবেদনে হাইকোর্ট তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পরদিন পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রেফতারে সহযোগিতা চেয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ১৫ মে পুলিশকে চিঠি দিয়ে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিওর (সিআরপিসি) অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলে। ওইদিন রাতেই মিলিটারি পুলিশের সহায়তায় ঢাকা সেনানিবাসের বাসভবন থেকে তারেক সাঈদ ও মেজর আরিফ হোসেনকে গ্রেফতার করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ। পরদিন রাতে নৌবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা এম এম রানাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশের কাছে তুলে দেন। প্রতিরক্ষা বাহিনীর এই তিন কর্মকর্তাকেই বাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়।

অভিযোগ গঠন : ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল র?্যাবের ২৫ জন (চাকরিচ্যুত) কর্মকর্তা-সদস্যসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। সাত মাসে ৩৮ কর্মদিবসে মামলার কার্যক্রম ও শুনানি চলে। গত বছরের ৩০ নভেম্বর জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেন।

নিম্ন আদালতের রায় : চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি সাত খুন মামলার রায় দেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত। রায়ে র?্যাবের সাবেক ১৬ কর্মকর্তা-সদস্য এবং নারায়ণগঞ্জের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তার অপরাধজগতের নয় সহযোগীসহ মোট ২৬ জনের মৃত্যুদ-ের আদেশ দেন আদালত। এ ছাড়া র?্যাবের আরো নয়জন সাবেক কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচজন পলাতক। তারা হলেন সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম, নূর হোসেনের সহকারী সানাউল্লাহ ও শাহজাহান। ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ড সহ বিভিন্ন মেয়াদে দন্ড প্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক দুজন হলেন করপোরাল মোখলেছুর রহমান ও এএসআই কামাল হোসেন।

নিম্ন আদালতে রায়ের দিন : সেদিন সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ আদালত এলাকা ও আশপাশে ছিল কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। বিচারক আসার বেশ আগেই এজলাসকক্ষ ভরে যায় সাংবাদিক ও আইনজীবীদের উপস্থিতিতে। এজলাসকক্ষের ভেতর আসামিদের রাখার জন্য কাঠগড়ার স্থলে একটি লোহার খাঁচা ছিল। সকাল নয়টার আগেই বেশ কিছু আসামিকে সেই খাঁচার ভেতরে এনে রাখা হয়। রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এজলাসে থাকা আইনজীবীদের অনেকে একযোগে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে সন্তোষ প্রকাশ করেন। পাঁচ মিনিটে রায় ঘোষণা শেষ করে বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন এজলাস ছেড়ে যান। এরপর আদালত চত্বরে আইনজীবীরা মিছিল করে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। রায় ঘোষণার পর আসামিরা ছিলেন নির্বিকার। প্রধান আসামি নূর হোসেনকে আশপাশের আসামিদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে নূর হোসেন খাঁচার বাইরে থাকা তারেক সাঈদের সঙ্গে কথা বলেন। এজলাসে উপস্থিত ছিলেন রানার শাশুড়ি ও তারেক সাঈদের বাবা মুজিবুর রহমান। তারা কেউ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় কিছু বলতে রাজি হননি।

ডেথ রেফারেন্স ও আপিল : বিচারিক আদালতের রায় ও নথি এ বছরের ২২ জানুয়ারি হাইকোর্টে পৌঁছায়, তা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে নথিভুক্ত হয়। শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন প্রধান বিচারপতি। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ৩৫ আসামির মধ্যে ২৮ জন আপিল করেন। পরে বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে গত ২২ মে শুনানি শুরু হয়। ৩৩তম দিনে ২৬ জুলাই শুনানি শেষ হয়। রায়ের জন্য ১৩ আগস্ট দিন রেখেছিলেন আদালত। ১৩ আগস্ট রায়ের তারিখ পিছিয়ে ২২ আগস্ট নতুন তারিখ ধার্য করেন একই বেঞ্চ। পরে গতকাল ১৫ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায় দেন উচ্চ আদালত।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, ২৩ আগস্ট ২০১৭,

লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসপি

Scroll to Top