বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর পুলিশের সঙ্গে আরও বেশি সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে বিক্ষুব্ধ জনতা। এতে বহু হতাহতের ঘটনাও ঘটে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কর্মবিরতিতে যান অধস্তন পুলিশ সদস্যরা।
হামলা হতে পারে এই ভয়ে পুলিশ সদস্যরা থানায় তালা মেরে পালিয়ে থাকায় বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী শুরু হয়েছে নৈরাজ্য, লুটপাট আর ডাকাতি।
দুর্বৃত্ত ও ডাকাতরা যে যার মতো বাসা-বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে হামলা করছে। সাথে লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। রাত গভীর হলে আতঙ্ক বাড়ছে রাজধানীবাসীর মাঝেও।
বুধবার দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আরশিনগর, আটিবাজার, নয়াবাজার, বসিলা, বসিলা মেট্রো হাউজিং, মোহাম্মদপুরের কাদিরাবাদ হাউজিং, শেখেরটেক, জিগাতলা, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ এলাকা, শনিরআখড়া, মিরপুরের পল্লবী, মিরপুর ১০, ইসিবি চত্বর এলাকা, উত্তরার ৮-৯, ১০-১১ নম্বর সেক্টর, গাজীপুর ও টঙ্গী কলেজ রোড এলাকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং রাজশাহী মিলে প্রায় ২৯ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
মিরপুর পল্লবী এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে আটক হয়েছেন ১৭ জন। আটক হওয়া কয়েকজন ডাকাত এলাকাবাসীর মারধরের সময় জানিয়েছেন, নাহিদ নামে এক যুবক তাদেরকে টাকা পয়সা দিয়ে নামিয়েছে এবং সেই সাথে বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩০০ যুবক সংগ্রহ করে এ কাজে লাগাচ্ছে নাহিদ। নাহিদও একজন ছিনতাইকারী এবং সন্ত্রাসী।
এছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের এ কাজে নামিয়েছে বলে জানায় তারা।
আটকদের মধ্যে বসিলা এলাকা থেকে চারজন এবং মিরপুর থেকে ১৭ জনকে এলাকাবাসী আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ডাকাতদের এলোপাতাড়ি অস্ত্রের আঘাতে মিরপুরের ইসিবি চত্বর এলাকায় দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু তাদের নাম-পরিচয় এখনও জানা যায়নি।
এছাড়া মোহাম্মদপুর এলাকায় পাঁচজনকে অস্ত্রসহ আটক করে এলাকাবাসী। পরে তাদেরকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এছাড়াও উত্তরা এলাকায় কয়েকজন আটক করেছে এলাকাবাসী।
সুমি নামে একজন জানান, বসিলা মেট্রো হাউজিং, সিটি হাউজিংয়ে ডাকাত ঢুকেছিল। এ সময় তারস মেট্রোর কয়েকটা বাসা থেকে অস্ত্র ধরে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যায় ডাকাতরা। এরপর সেনা সদস্যরা চলে আসায় আবার সিটি হাউজিং এ ঢুকে পড়ে। তবে সিটি হাউজিংয়ের কারো বাসায় ঢুকতে পারেনি। এর আগেই দু’জনকে ধরতে পারেন এলাকার লোকজন। বাকিরা পালিয়েছে। এলাকাবাসী সবাই নিজ নিজ বাড়ি পাহারা দিচ্ছে।
এছাড়া ঢাকার বাইরে বাইক নিয়ে ডাকাতি করতে এসে জনতার হাতে আটক হয়েছেন এক যুবক। বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী জেলার নওহাটা বাজারে এ ঘটনা ঘটে। পরে তাকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয় লোকজন। এছাড়াও গাজীপুর ও টঙ্গী এবং সাভার এলাকায় ডাকাতির খবর পাওয়া গেছে।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকার লাল খান এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে চার যুবক এলাকাবাসীর হাতে আটক হয়েছেন। পরে তাদেরকে উত্তম-মধ্যম দেন এলাকাবাসী। কিন্তু বাকিরা পালিয়ে যায়।
ভুক্তভোগী এলাকার অধিকাংশ মানুষ জানিয়েছেন, যারা ডাকাতি করতে এসেছিল বেশিরভাগ টোকাই এবং উঠতি তরুণ। তাদেরকে অস্ত্র এবং টাকা সরবরাহ করে পরিকল্পিতভাবে এসব করানো হচ্ছে। যাতে দেশে কেয়ারটেকার সরকার শপথ নিতে না পারে এবং সেই সুযোগে দেশে সেনা শাসন আসে। মানুষের মাঝে আতঙ্ক তৈরিতেই সারাদেশে একযোগে এই ডাকাতি চলছে বলে মনে করছেন তারা।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, আটকরা জানিয়েছেন তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের নির্দেশে ডাকাতিতে নেমেছেন।
স্থানীয়রা জানান, এলাকায় ডাকাতি হচ্ছে খবর পেয়ে মসজিদের মাইকে সতর্ক করা হয়। পরে লোকজন লাঠিসোটা ও যার যা অস্ত্র ছিল তা নিয়েই রাস্তায় বেরিয়ে আসেন এবং তাদের ধাওয়া করেন। বিভিন্ন জায়গায় ডাকাত সদস্যরা আটকও হয়েছেন। তবে এই অবস্থা কতদিন ধরে চলবে তারা তা জানেন না। বিষয়টি নিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসি-তামাশাও করছেন। তবে কেউ কেউ ডাকাতির প্রমাণস্বরূপ এলাকায় ডাকাতদের ধাওয়া দেওয়া ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এমন ঘটনার পরও ফেসবুকে একটি গোষ্ঠী ডাকাতের এই ঘটনাকে মিথ্যা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুধবার রাত নয়টার দিকে মিরপুরের ইসিবি চত্বরের একটি টাওয়ারে ঢুকে শতাধিক যুবক। তাদের হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। এসময় তারা ৭০টি ভবনে ঢুকে পড়ে ও ভবনগুলোর বাসিন্দাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ডাকাতি শুরু করে। খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে তারা এলাকার সব গেট বন্ধ করে দেন। এরপর ধাওয়া দিয়ে তাদের ধরে ফেলেন। এ সময় গণপিটুনিতে একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে তার নাম পরিচয় কেউ জানাতে পারেনি। পরে এলাকাবাসী দু’জনকে আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেন। তার আগে এলাকাবাসী বেধড়ক গণপিটুনি দেয় তাদের। এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে আনে সেনাবাহিনী।
আরও জানা গেছে, তার আগে সেনাবাহিনীর কয়েক প্লাটুন সদস্য এসে ভবনগুলো ঘেরাও করে। তারা ভবনগুলোতে ঢুকে পড়া ডাকাত সদস্যদের উদ্দেশ্যে হ্যান্ড মাইক দিয়ে বলতে থাকেন তারা যদি বের না হয়ে আসে তবে তারা ভেতরে প্রবেশ করে গুলি চালাতে বাধ্য থাকবে। এমন কথা শোনার পর ডাকাত সদস্যরা চুপ করে থাকলে সেনাবাহিনী গুলি করতে বাধ্য হয়। পরে তারা আসার চেষ্টা করলে জনগণ তাদের ধরে গণধোলাই দেন এবং ১৭ জনকে আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেন তারা। আটকরা সবাই টোকাই বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী। প্রায় ঘণ্টা ধরে এই অভিযান চলে। তাদের ধরতে ৭০টি ভবনের প্রতিটিতে ঢুকে পড়েন সেনারা। তখন বাইরে সাইরেন বাজছিল। পরে আরও কয়েকটি গাড়ি আসে।
সেই এলাকার বাসিন্দা মেরিনা মিতু নামে একজন বলেন, আমাদের ইসিবি এলাকায় রাত নয়টার দিকে ২০০/৩০০ ডাকাত এক সাথে ৭০টি ভবনে ঢুকেছিল। ঢুকেই তারা এলোপাতাড়ি কোপ দিতে শুরু করে। এসময় রাস্তায় খেলতে থাকা দুটি বাচ্চা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। পরে আমরা।