লিবিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশ থেকে যে কর্মীরা কাজ করতে যান, তাঁদের অন্তত ১১ শতাংশের উদ্দেশ্য থাকে ইউরোপ পাড়ি দেওয়া। এই কর্মীরা অবৈধ পন্থায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের ইতালি, মাল্টা, গ্রিস, সাইপ্রাস, স্পেনসহ পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের বেশ কিছু দেশে পাড়ি দেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি কর্মী পাড়ি জমান ইতালিতে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ‘ডিসপ্লেসমেন্ট ট্রেকিং ম্যাট্রিক্স’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনটি সম্প্রতি লিবিয়ায় প্রকাশ করা হয়। ২০২৩ সালে লিবিয়ায় অবস্থান করা ৪০৫ জন বাংলাদেশি কর্মীর সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।
প্রতিবেদনটির তথ্য অনুসারে ২০২৩ সালে ১৩ হাজার ৭৭৩ জন বাংলাদেশি কর্মী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি, মাল্টা, গ্রিস, সাইপ্রাস ও স্পেনে গেছেন। তাঁদের মধ্যে ৯০ শতাংশ পাড়ি জমিয়েছেন ইতালিতে।
তবে এই সংখ্যা ২০২২ সালের তুলনায় ১৬ শতাংশ কম। ২০২২ সালে সমুদ্রপথে পাড়ি জমিয়েছিলেন ১৬ হাজার ৪৮৭ জন। এই কর্মীরা পূর্ব ভূমধ্যসাগর দিয়ে প্রথমে তুর্কি, সেখান থেকে গ্রিস, পরে পশ্চিম বলকান হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করেন।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া বন্ধ করতে হলে বাংলাদেশি কর্মীদের লিবিয়ায় যাওয়ার পথই বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
কর্মীরা যাতে বৈধ কিংবা অবৈধ কোনো পথেই লিবিয়া যেতে না পারেন সে জন্য সরকারকে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা এ কথা বললেও বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছর প্রথম ছয় মাসে আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশিসংখ্যক কর্মী বৈধ পথে লিবিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। বিএমইটির তথ্যে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় গেছেন ৬২৫ জন কর্মী, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৪১.২৮ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া গেছেন ৩৬৭ জন। আর ২০২২ সালে গেছেন ১৭২ জন এবং ২০২১ সালে গেছেন তিনজন কর্মী।
আইওএমের তথ্যও বলছে, ২০২১ সালে লিবিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি কর্মীদের চেয়ে ২০২৪ সালে লিবিয়ায় অবস্থান করা বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে। ২০২১ সালে লিবিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা ছিল ২০ হাজার ৩৫১। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ হাজার ১৩৪।
বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া যেতে ব্যবহার করা হয় ৪ রুট
আইওএমের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে চারটি রুট ব্যবহার করে কর্মীরা লিবিয়ায় যান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় তুরস্কের পথ। রুটগুলোয় পৃথক অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়। এসব রুটে কর্মীদের দুই লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়।
আইওএমের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশি কর্মীদের ভাষ্যমতে অন্তত ৫০ শতাংশ কর্মী তুরস্ক হয়ে লিবিয়ায় যান। এই রুটে খরচ হয় চার লাখ ৮৬ হাজার ৭৮০ টাকা। অন্য রুটগুলো দিয়ে যান ৩০ শতাংশ বাংলাদেশি কর্মী। এই কর্মীদের খরচ হয় দুই লাখ ২৪ হাজার ৮৪৬ টাকা।
এসব রুটের বাইরে সরাসরি বৈধ পথে লিবিয়ায় যান ১২ শতাংশ কর্মী। তাঁদের খরচ হয় তিন লাখ ৫৯ হাজার ২৯০ টাকা। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর হয়ে অবৈধ পথে লিবিয়ায় যান ৮ শতাংশ কর্মী। তাঁদের খরচ হয় চার লাখ ৭৯ হাজার ২১৬ টাকা।
৪ কারণে লিবিয়ায় কর্মী যান
লিবিয়ায় অবস্থান করা বাংলাদেশি কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে আইওএম জানতে পারে, চারটি কারণে বাংলাদেশ থেকে কর্মীরা বৈধ কিংবা অবৈধ পথে লিবিয়ায় যান। এর মধ্যে রয়েছে নিজ দেশে প্রয়োজনীয় আয় করতে না পারা, দেশে চাকরির সংকট, বিদেশেই কর্মসংস্থানের সন্ধান এবং পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা। এই কর্মীদের বেশির ভাগ লিবিয়া হয়ে ইউরোপ পৌঁছে এসব কারণের সমাধান করতে চান।
চারটি কারণের মধ্যে নিজ দেশে আয়ের সংস্থান করতে না পারা কর্মীর সংখ্যা বেশি। অন্তত ৬১ শতাংশ কর্মীর দেশে আয়ের কোনো পথ ছিল না। ২২ শতাংশ কর্মী দীর্ঘ সময় চাকরির সন্ধান করেও মেলাতে পারেননি। ১২ শতাংশ কর্মী বিদেশেই কর্মসংস্থান নিশ্চিত করবেন বলে লিবিয়ায় গেছেন, আর ২ শতাংশ কর্মী পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে লিবিয়ায় গেছেন।
আইওএম যেসব কর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে তাঁদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ বলেছেন তাঁরা লিবিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৬৭ শতাংশের কাজের অনুমোদন রয়েছে। অন্য ২০ শতাংশ অবৈধ পথে লিবিয়ায় গিয়ে কাজ করছেন। লিবিয়ায় বেশির ভাগ বাংলাদেশি কর্মী নির্মাণ শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও খাবার সরবরাহকারী কর্মী হিসেবে কাজ করেন।
আইওএমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া এক হাজার ৬৬৮ জন বাংলাদেশিকে লিবিয়ার উপকূলে ফেরত নিয়ে আসা হয়।
এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় লিবিয়ার শ্রমবাজারের পথ পুরোপুরি বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন দীর্ঘদিন আইওএমের সঙ্গে কাজ করা অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘লিবিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটেও স্থীতিশীল নয়। আর বাংলাদেশ থেকে যারা লিবিয়ায় যায় তাদের মূল উদ্দেশ্য অবৈধ পথে ইউরোপ পাড়ি দেওয়া। লিবিয়ার অস্থিতিশীল পরিবেশে সেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের কাজ করার খুব বেশি সুযোগও নেই। সব মিলিয়ে লিবিয়ায় যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘এই পথ বন্ধ করার ক্ষেত্রে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। দেশের অভিবাসন বিভাগকে নির্দেশনা দিয়ে বলা যেতে পারে, যারা লিবিয়ার উদ্দেশে বিমানবন্দর যাবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে এবং লিবিয়ায় যেতে নিরুৎসাহ করতে। এ ছাড়া সরকারের সচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া পর্যন্ত রুটে যে অপরাধীচক্র গড়ে উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’