সকাল ৯টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বহির্বিভাগে একজন চিকিৎসক গড়ে এক শর বেশি রোগী দেখেন। অথচ এই সময়ে তার রোগী দেখার কথা ২০ থেকে ৩০ জন, যে কারণে রোগীরা সময় কম পান -ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, পরিচালক, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
রোগী দেখার জন্য তিন মিনিটের বেশি সময় দিতে পারেন না চিকিৎসকরা। সামান্য অসুখেও কমপক্ষে দুইবার যেতে হয় চিকিৎসকের কাছে। গুনতে হয় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা।
চিকিৎসকরা রোগীদের কতটুকু সময় দেন এবং এতে রোগ নির্ণয় ও সুস্থতা কতটা যথাযথ হচ্ছে—এ ব্যাপারে সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও দুটি প্রাইভেট চেম্বারে আসা ২০ জন রোগী সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
গত রবিবার সকাল ৯টায় কা ঢামেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, লম্বা লাইনে শতাধিক মানুষ টিকিট নিচ্ছে। মেডিসিন বিভাগে অপেক্ষায় আরো দুই শতাধিক চিকিৎসাপ্রত্যাশী।
সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত হাসপাতালটির মেডিসিন বিভাগের সামনে অপেক্ষা করে দেখা যায়, ৬ ও ৭ নম্বর কক্ষের সামনে লাইনে থাকা প্রথম ১০ জন রোগীকে ৩০ মিনিটের কম সময়ে সেবা দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসা নিতে আসা রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের রোজিনা বেগম (৪৫) বলেন, ‘ভালো করে সমস্যার কথা কইতে পারলাম না।
চেয়ারে বওয়ার আগেই ওষুধ ও পরীক্ষা লিখে কয়, ওষুধগুলো খাবেন, ভালো না হইলে তিন দিন পর এই পরীক্ষা করে সাক্ষাৎ করবেন।’
রোজিনা জানান, তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা। এখানে এ নিয়ে তিনবার আসতে হয়েছে। প্রতিবার আসা-যাওয়া, পরীক্ষা আর ওষুধে দুই হাজার টাকার বেশি খরচ হচ্ছে।
চিকিৎসা নিতে আসা আরেক নারী ফারিয়া ইসলাম (২৬) জানান, সমস্যা হলো উনারা (চিকিৎসক) সময় নিয়ে কথা শুনতে চান না। যে কারণে দুই-তিন হাসপাতালে আসতে হয়। তিনি বলেন, ‘সমস্যা কী? রিপোর্ট এনেছেন? এই কথার বাইরে কেনো কথায় বলেননি। ঘড়ি ধরে দেড় মিনিটের মতো সময় দিয়েছেন।’
১০০-র বেশি রোগী দেখেন একজন চিকিৎসক
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বহির্বিভাগে গড়ে প্রতিদিন চার হাজার ২০০ জন রোগী আসে। সেবা দেন কমবেশি ৬০ জন চিকিৎসক। সে হিসাবে একজন রোগী গড়ে চার মিনিটের বেশি সময় পাওয়ার কথা। তবে টানা পাঁচ ঘণ্টা রোগী দেখা কোনো চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব হয় না। মাঝখানে দুই-তিনবার বিরতি নেন তারা। সব মিলিয়ে গড়ে তিন মিনিটের কম সময় পায় একজন রোগী।
চিকিৎসকদের কাছ থেকে রোগীরা সময় কম পাওয়ার কারণ হিসেবে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সকাল ৯টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বহির্বিভাগে একজন চিকিৎসক গড়ে ১০০-র বেশি রোগী দেখেন। অথচ এই সময়ে তার রোগী দেখার কথা ২০ থেকে ৩০ জন। যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই রোগীরা সময় কম পান।’
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘মাঝে মাঝে রোগীর সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও থাকে না। এ ছাড়া চিকিৎসক সংকট তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে একজন চিকিৎসক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না।’
চেম্বারে হাজার টাকায় গড়ে তিন মিনিটের সেবা
গত সোমবার রাত ৮টা ৫৫ মিনিট। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসকের কক্ষের বাইরে অপেক্ষারত রোগীর ভিড়।
নোয়াখালীর মীর হোসেন (৫৫) কার্ডিয়াক বিশেষজ্ঞের কক্ষ থেকে বের হয়ে তার ছেলেকে বলছেন, আবার পরীক্ষা দিয়েছে। আর সম্ভব নয়।
মীর হোসেন বলেন, ‘এক হাজার টাকা করে ফি নিয়েছেন। দুজন রোগীকে একসঙ্গে পাঁচ-ছয় মিনিট দেখেন। আমার সঙ্গে কথা বলেছেন সর্বোচ্চ দুই মিনিট। এর মধ্যে এক মিনিট রিপোর্ট দেখছেন। যতবার আসি, শুধু পরীক্ষা করতে দেন। এ নিয়ে আমার ৫০ হাজার খরচ হয়েছে শুধু পরীক্ষা করাতে।’
সবচেয়ে কম সময় ব্যয় করেন পাকিস্তানিরা
৬৭টি দেশের ওপর করা গবেষণার ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল বলছে, বিশ্বে পাকিস্তানে চিকিৎসকরা রোগীপ্রতি সবচেয়ে কম সময় ব্যয় করেন। চিকিৎসকরা একজন রোগীর পেছনে গড়ে ১.৮০ সেকেন্ড সময় দেন। ভারত, চীন ও বাংলাদেশের চিকিৎসকরা রোগীর পেছনে গড়ে দুই মিনিট সময় দেন।
২০১৭ সালে প্রকাশিত এই নিবন্ধে দেখা যায়, সুইডেনের চিকিৎসকরা রোগীকে সবচেয়ে বেশি ২২ মিনিট সময় দেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে ২১ মিনিট, জাপানে ১০ মিনিট ২ সেকেন্ড, সিঙ্গাপুরে ৯ মিনিট ৩ সেকেন্ড।
চিকিৎসক সংকট অন্যতম কারণ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহামেদ বলেন, ‘ওষুধের নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে রোগীর বেশি সময় দরকার চিকিৎসকের কাছ থেকে। কিন্তু একজন রোগীর জন্য একজন চিকিৎসক কত সময় ব্যয় করবেন, তা কোনো দেশে নির্দিষ্ট করে দেওয়া নেই।’
তিনি বলেন, ‘একজন রোগীর জন্য কতটুকু সময় প্রয়োজন, এটা নির্ভর করবে অসুস্থতা ওপর। সামান্য রোগ হলে এ ক্ষেত্রে কম সময় লাগে, তবে জটিল রোগীর ক্ষেত্রে সময় বেশি লাগে। আমাদের এখানে সমস্যা হলো রোগী অনেক সময় তার সমস্যাগুলো সঠিকভাবে বলতে পারেন না বা বলার সুযোগ পান না।’
বে-নজির আহামেদ বলেন, ‘যে ধরনের রোগীই হোক না কেন, এক-দুই মিনিটে চিকিৎসাসেবা হবে না। তার রোগ নির্ণয়, ব্যবস্থাপনা—কোনোটাই এত কম সময়ে ভালোভাবে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর অনুপাতে চিকিৎসক ব্যবস্থা রাখা। সেই সঙ্গে নির্ধারিত করে দেওয়া একজন চিকিৎসক কতজন রোগী দেখবেন। রেফারেল পদ্ধতি যত দ্রুত সম্ভব চালু করা। এমবিবিএস চিকিৎসকে প্রাইমারি সেবায় নিয়োজিত করা এবং বিশেষজ্ঞদের জটিল রোগীর সেবা নিয়োজিত রাখা।’