ঘটনার দীর্ঘ ১৩ বছর পর সাভারের সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত শামসুদ্দোহা খান মজলিশের স্ত্রী সেলিমা খান মজলিশ (৬৩) হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রহস্যের কিনারা করার সঙ্গে সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে সন্দেহভাজন তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে সাবেক এমপির মেয়ে শামীমা খান মজলিশ ওরফে পপিও (৫৭) আছেন।
পিবিআই বলছে, তদন্তে বেরিয়ে এসেছে মূলত শামীমা খান মজলিশের পরকীয়া সম্পর্কের জেরে তাঁর পরিকল্পনায়ই সেলিমা খান খুন হয়েছেন। রাজধানীর ধানমণ্ডিতে অবস্থিত পিবিআই হেডকোয়ার্টার্সে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পুলিশের তদন্তবিষয়ক কর্তৃপক্ষটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।
শামসুদ্দোহা-সেলিমা দম্পতির মেয়ে শামীমা ছাড়া তদন্তের সূত্রে গ্রেপ্তার অন্য দুজন হলেন, গৃহকর্মী আরতি সরকার এবং বাসার বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি সুবল কুমার রায় (৫০)। গত ৪ জুন সাভারের ভাগলপুর ও পাকিজা এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
পিবিআই বলছে, শামীমা খান পপির সঙ্গে গ্রেপ্তার সুবল কুমার রায়ের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। এর পাশাপাশি পারিবারিক সম্পত্তি ও রাজনীতিবিষয়ক বিরোধের জেরে এমপির স্ত্রীকে হত্যা করা হয়।
পিবিআইপ্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘দীর্ঘদিন হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন না হওয়ায় মামলার তদন্তকাজ এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। পরে আবার আমরা ঘটনার তদন্ত শুরু করে নিহতের বড় মেয়ে আসামি শামীমা খান মজলিশসহ তিন মেয়েকেও সন্দেহের মধ্যে রাখি।’
পিবিআইপ্রধান সাংবাদিকদের জানান, নতুন করে তদন্ত শুরু হলে সেলিমা খান মজলিশের বাসায় কারা কারা যেতেন তার খোঁজ নেওয়া হয়। জানা যায়, সাভার এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত ইলেকট্রিশিয়ান সুবল কুমার রায় মাঝেমধ্যে ওই বাসায় যেতেন। তদন্তে বাসার বৈদ্যুতিক সুইচ বোর্ড ভাঙা থাকার বিষয়ও উঠে আসে। এরপর পুলিশ সুবল কুমার রায়কে আটক করে।
পিবিআইপ্রধান বনজ কুমার মজুমদার আরো বলেন, সুবল কুমার গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শামীমা খান মজলিশের সঙ্গে তাঁর পরকীয়া সম্পর্ক এবং এর জেরে তাঁর মাকে হত্যার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
সুবল কুমার রায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানান, শামীমা তাঁর স্বামীকে নিয়ে বাড়ির নিচতলায় থাকতেন। ওই বাড়িতে বৈদ্যুতিক কাজের সূত্রে নিয়মিত যাতায়াতের এক পর্যায়ে তিনি শামীমার স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত হন। সুবল রায় বলেছেন, ২০০১ সালে তিনি শামীমা খানের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি ২০০৫ সালে জানাজানি হলে সুবলকে মারধর করা হয় আর ওই বাসায় যেতে নিষেধ করা হয়। ২০০৮ সালে সুবল বিয়ে করেন। এর তিন বছর পর থেকে তিনি আবার সেই বাসায় যাতায়াত শুরু করেন।
পিবিআইপ্রধান বলেন, হত্যাকাণ্ডের দিন ২০১১ সালের ১৪ জুন ভোরে শামীমার মা সেলিমা খান মজলিশ ছাদ থেকে দেখেন সুবল চুপিচুপি তাঁর বাড়ির দিকে আসছেন। এটি দেখে তিনি চিৎকার করতে করতে নিচে নামতে থাকেন। তখন সুবল ও শামীমা তাঁর চিৎকার থামাতে ওপরে যান। মাকে থামাতে শামীমা তাঁকে জাপটে ধরে পাশে থাকা ফল কাটার ছুরি দিয়ে কয়েকবার আঘাত করেন। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে সুবল ইলেকট্রিক বোর্ড ভেঙে সেখান থেকে দুটি তার বের করে সেলিমা খান মজলিশের মাথায় বৈদ্যুতিক শক দেন। রক্তাক্ত, গুরুতর আহত সেলিমাকে সেই অবস্থায় একটি ঘরে শুইয়ে রেখে আসামিরা বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
পরে সেলিমা খানকে গলা ও পেট কাটা অবস্থায় উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। চিকিৎসাধীন অবস্থায় চার দিন পর সেলিমা খান মারা যান।
এ ঘটনায় নিহতের ভাই মো. শাফিউর রহমান খান বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন। মামলার পর নিহতের নাতনি জামাই আবুল কালাম আজাদ ও গৃহকর্মী সরস্বতীর স্বামী হরিপদ সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। থানা পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরে মামলাটির তদন্তভার সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। সিআইডি চার বছর তিন মাস ২৪ দিন এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে।
তদন্তকালে সিআইডি অপরাধে জড়িত সন্দেহে মো. আবু সুফিয়ান ওরফে রানা (৩২) নামের একজনকেও গ্রেপ্তার করেছিল। কিন্তু তদন্তে তাঁদের সম্পৃক্ততা না মেলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে নাম বাদ দেওয়া হয়। এরপর ২০১৫ সালের অক্টোবরে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। পরে আদালত মামলাটি পুনঃ তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন।