হলি আর্টিজানের কথা মনে রাখতে হবে

বাঙালি জাতির অগণিত গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের মধ্যে দুর্ভাগ্যজনক কলঙ্কিত ঘটনার সংখ্যাও একেবারে কম নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কলঙ্কজনক ঘটনা। এই কলঙ্কের হাত ধরেই আসে আরেক বড় কলঙ্ক, সামরিক স্বৈরশাসকের আবির্ভাব। পর পর আগত দুই সামরিক শাসকের হাত ধরে এবং পরবর্তী সময়ে তার সূত্রেই সব কলঙ্কের জন্ম হয়েছে, যার তালিকা অনেক লম্বা।

বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতির ইতিহাস নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার-বিশ্লেষণ করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন দুই সামরিক শাসকের প্রবর্তিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতির সুযোগে এবং প্রভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনীতিতে ধর্মান্ধতার প্রবেশ ঘটেছে এবং তার সূত্রেই জন্ম হয়েছে তথাকথিত জিহাদতন্ত্র, জঙ্গিবাদ ও সেই সূত্রে সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন, যার চরম পরিণতি দেখা যায় ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনায়।

হলি আর্টিজান ঘটনার ৯ বছর পরও দুই সামরিক শাসকের রাজনীতি ও তার সূত্রে আগত ধর্মান্ধতা শুধু বহাল আছে তা নয়, ধর্মান্ধতার ডালপালা ও শিকড় বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সমাজের সর্বত্র নীরব ও সরবে বিস্তৃত হচ্ছে বিধায় এই বিভীষিকাময় দিনটি এলে উল্লিখিত সব কলঙ্ক ও জঞ্জালের কথা সামনে আসে। হলি আর্টিজানের পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে ঘটবে, তা আমি মনে করি না। তবে সেদিন মানুষরূপী পশুরা যে লক্ষ্যে ওই ঘটনা ঘটিয়েছিল, সেই লক্ষ্যে ধাবিত হওয়া থেকে এই ৯ বছরে বাংলাদেশকে কতটুকু টেনে ধরা গেছে অথবা সেই পথকে কি আমরা চূড়ান্তভাবে বন্ধ করতে পেরেছি, এসবের মূল্যায়ন হওয়া উচিত।

তা করতে হলে সব শ্রেণি-পেশাসহ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জনমানুষের মানসতন্ত্রের মতিগতির প্রবাহ কি গড়পড়তায় সামগ্রিকভাবে প্রগতিশীল আধুনিকতার দিকে যাচ্ছে, নাকি প্রকৃত ধর্ম নয়, ধর্মের লেবাসে ধর্মান্ধতার দিকে যাচ্ছে তার মূল্যায়ন প্রথমে হওয়া উচিত। এসব বিষয়ে আলোকপাত করার আগে ২০১৬ সালের পয়লা জুলাইয়ে সংঘটিত সেই কলঙ্কের কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি।

বিভীষিকা আর বীভৎসতায় পূর্ণ অন্ধকার সেই রাতে ধর্মান্ধ জঙ্গিরা কাপুরুষের মতো ২২ জন নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে, যার মধ্যে দুজন পুলিশ সদস্যসহ তিনজন বাংলাদেশি ছিলেন। বাকিরা সবাই ছিলেন বিদেশি, যাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন আমাদের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের সঙ্গে জড়িত।

এই ঘটনাকে কখনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা হয়নি, কেউ বলেনি। এটি আজ নিশ্চিত করে বলা যায় বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং যেভাবে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা অব্যাহত থাকলে জঙ্গি-সন্ত্রাস উত্থানের কোনো সুযোগই থাকত না। অনেক আগেই বাংলাদেশ হতো একটি উন্নত, আধুনিক ও সমৃদ্ধিশালী পরম সম্প্রীতির দেশ। জার্মানির খ্যাতিমান নিরাপত্তা বিশ্লেষক সিগফ্রিড উলফ ২০১৫ সালের এক গবেষণাপত্রে বলেছেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের মূল হোতা দুই সামরিক শাসক, যাঁরা সেক্যুলার রাজনীতির বদলে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির প্রবর্তন এবং ধর্মের কার্ড ব্যবহার করেছেন নিজেদের বৈধতার ঘাটতি পূরণের জন্য। ২০১৬ সালের ১ জুলাই ধর্মের নামে যে চরম অধর্মের কাজ হয়েছে, সে কথা মনে এলেই একাত্তরের গণহত্যাকারী পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার কথা মনে আসে, যিনি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে সংলাপ চলাকালে মদের গ্লাস হাতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আসুন শেখ মুজিব, আমরা ইসলাম রক্ষা করি’ (সূত্র : পাকিস্তান বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি, হুসেন হাক্কানী, পৃৃষ্ঠা ৭৫)।

যুগে যুগে ইসলাম বা ধর্ম রক্ষার নামে এমন কত কিছুই না হয়েছে!
একাত্তরের গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী ও ইসলামী নামধারী দলগুলো ১৯৭৫ সালের পরে যখন পুনরুত্থানের সুযোগ পেল, তখনই তারা বুঝেছিল একদিন তাদের অস্তিত্ব বড় রকম সংকটে পড়বে। সুতরাং সুদূরপ্রসারী কৌশল হিসেবে তারা গোপনে সশস্ত্র সংগঠন তৈরি করে এবং প্রকাশ্যে পঁচাত্তরের রক্তের সিঁড়ি ধরে তৈরি হওয়া মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতির বড় পক্ষের সঙ্গে শক্ত মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এর ফলে দেখা যায় ২০০১-০৬ মেয়াদে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থা ও বাহিনীকে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিকে বাংলাদেশ থেকে চিরতরে বিদায় জানানোর পথ বেছে নেয়। সে লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ সব সিনিয়র নেতাকে একযোগে হত্যা করার জন্য তারা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট প্রকাশ্য দিবালোকে ভয়াবহ গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর যে চেষ্টা তাদের পূর্বসূরিরা ভিন্নভাবে করেছে, তারই পুনরাবৃত্তি সেদিন তারা ঘটানোর চেষ্টা করে। সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনকে আমরা দমন ও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির চলমান স্বরূপটি যদি আমরা বুঝতে ব্যর্থ হই এবং তার লাগাম যদি টেনে ধরতে না পারি, তাহলে আমাদের পরিণতি মিসরের মতো হতে পারে। তাই মিসরের ইতিহাসটি আমাদের জানা উচিত।

আধুনিক সময়ে বৈশ্বিক রাজনীতিতে ইসলামিস্ট কট্টরবাদী ধর্মান্ধতার রাজনীতি ও তার বাস্তবায়নের পথ দেখান মিসরের ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা হাসান-আল-বান্না (১৯০৬-১৯৪৯) এবং তাঁর সহযোগী সাঈদ কুতুব (১৯০৬-১৯৬৬)। সশস্ত্র কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে হাসান বান্না ১৯৪৯ সালে কায়রোতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন এবং সাঈদ কুতুবকে ফাঁসি দেন জামাল নাসের ১৯৬৬ সালে (সূত্র : মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস, এ বি এম হোসেন, পৃষ্ঠা ১৭২-৭৩)। ব্রাদারহুড বিভিন্ন মেয়াদে দীর্ঘ সময় ধরে নিষিদ্ধ থেকেছে। কিন্তু নীরবে বহু রকমের সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের মাধ্যমে এবং ব্যানারে তারা ঠিকই তাদের মতাদর্শের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। জামাল নাসের, আনোয়ার সাদাত এবং পরে হোসনি মুবারক দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থেকেও দেশের বৃহত্তর জনমানুষের ভেতরে ধর্মান্ধতার বিস্তার ঠেকাতে পারেননি বলেই হোসনি মুবারকের পতনের পর ২০১৩ সালে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে ব্রাদারহুড পরিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় চলে আসে। তারা সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং সংসদ নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করে। ২০১৩ সালে ক্ষমতায় বসেই ব্রাদারহুড

Scroll to Top