অবিলম্বে গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং ফিলিস্তিনের মুক্তির বিষয়টি সমগ্র বিশ্বে এখন অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলে প্রথমে নেতানিয়াহু মৌন সম্মতি জানালেও পরক্ষণেই তা নিয়ে বিতর্ক শুরু করেন। গাজার প্রতিরোধ আন্দোলনের মূল শক্তি হামাসকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার আগে কোনো যুদ্ধবিরতিতে যেতে নেতানিয়াহু দ্বিমত পোষণ করেন। নেতানিয়াহু ও জো বাইডেনের মধ্যে দ্বন্দ্বের মূল কারণ হচ্ছে তাঁদের নিজ নিজ অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থ।
নেতানিয়াহু মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে বিজয় লাভ করার জন্যই বাইডেন তাঁর ওপর এই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব চাপিয়ে দিচ্ছেন। এতে নেতানিয়াহুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হতে পারে, এমনকি আইনি প্রশ্নে কারাবরণও করতে হতে পারে। তাই ইসরায়েলের আগামী নির্বাচনে আবার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসার নিশ্চয়তা চান নেতানিয়াহু।
কিন্তু তাতে বাইডেন এবং এমনকি ইসরায়েলের বর্তমান বিরোধী দলের নেতা ইয়ার লাপিদও কোনো ছাড় দিতে রাজি হচ্ছেন না। কারণ তাঁরা উভয়েই মনে করেন, ইসরায়েলের দক্ষিণ কিংবা কট্টরপন্থীদের সমর্থনে নেতানিয়াহু আবার ক্ষমতাসীন হলে ফিলিস্তিন সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান কোনোমতেই সম্ভব হবে না। আগ্রাসনবাদী নেতানিয়াহু বিভিন্ন অজুহাতে ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া, লেবানন এবং এমনকি ইরাকেও তাঁর থাবা বিস্তার অব্যাহত রাখতে পারেন। সুতরাং তিনি ক্ষমতায় থাকলে কোনো যুদ্ধবিরতিই ফলপ্রসূ হবে না।
নেতানিয়াহু ভালো করেই জানেন, এই মুহূর্তে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল বিশ্ব রাজনীতি ও কূটনীতিতে একঘরে হয়ে পড়ছে। এমনকি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে সামগ্রিকভাবে। এতে ইসরায়েলকে সমর্থনকারী একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও এর অসামান্য নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কিন্তু তাতেও বেপরোয়া নেতানিয়াহু। কারণ তাঁর কাছে নিজের স্বার্থ এবং ইসরায়েলের প্রভাব-প্রতিপত্তি ধরে রাখার বিষয়টিই মুখ্য, আর বাকি সব কিছুই গৌণ।
নেতানিয়াহু মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭০ লাখ প্রভাবশালী ইহুদি একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পক্ষে। সে কারণেই তারা ইসরায়েলের তথাকথিত অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে হামাসসহ ফিলিস্তিনের সব প্রতিরোধ যোদ্ধার অবলুপ্তি কামনা করে। যুক্তরাষ্ট্রবাসী সেই ইহুদিদের পাশাপাশি ইসরায়েলেও এক শ্রেণির কট্টরপন্থী ইহুদি রয়েছে, যারা শুধু হামাস কিংবা গাজায় যুদ্ধরত অন্যান্য সংগ্রামী গোষ্ঠীই নয়, বরং লেবাননের গেরিলা সংগঠন হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতি-আনসারাল্লাহ বাহিনীকেও নিশ্চিহ্ন করার পক্ষপাতী। কিন্তু ইসরায়েল কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সব ইহুদিই এক নয়।
তাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে, যারা দখলকৃত ভূমির পরিবর্তে ইসরায়েল, ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যে তাঁরা কার স্বার্থে যুদ্ধবিরতি চানটেকসই শান্তি চায়। তারা লক্ষণীয় উন্নয়ন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানপ্রত্যাশী। শুধু তারা নয়, তাদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও চান সেই অঞ্চলে শান্তি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বার্থে ইহুদিবাদী ও আগ্রাসী মনোভাবসম্পন্ন নেতানিয়াহু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত কৌশলী নেতানিয়াহু ও তাঁর সমর্থকরা (ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী) সেটি চায় না। উল্লিখিত অংশটি মনে করে নেতানিয়াহু ক্ষমতা থেকে সরে গেলে কালের পরিক্রমায় একদিন ইসরায়েল নামের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়বে।
বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনার পটভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনি মনে করেন, আসন্ন নির্বাচনে হেরে গেলে এবং কোনোক্রমে, তাঁর ভাষায়, ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন ও লম্পট’ ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হলে সমগ্র বিশ্বব্যবস্থা পাল্টে যেতে পারে। ট্রাম্প ও তাঁর ইহুদি জামাতা জ্যারেড কুশনার ইসরায়েল ও বিশেষ করে বিবির (নেতানিয়াহু) ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তাঁদের প্রচেষ্টায়ই ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ নামের একটি চুক্তির অবতারণা করা হয়েছিল, যাতে আরব আমিরাত, সুদান, মরক্কো, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো দু-একটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র যোগ দেয়। কিন্তু তাতে যোগ দেয়নি অন্যতম প্রধান মুসলিম রাষ্ট্র সৌদি আরব। সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে চায় শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিসহ উন্নত সমরাস্ত্র, যা তার সার্বভৌমত্বকে ইরান কিংবা অন্য কোনো প্রতিবেশীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু সেটি ইসরায়েলের সম্মতি ছাড়া কোনোক্রমেই সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এ ব্যাপারে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাক্ষরিত একটি গোপন চুক্তি রয়েছে।
সে কারণে ভবিষ্যতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের অস্তিত্ব রক্ষায় হুমকি হতে পারে—এমন আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে তার পঞ্চম প্রজন্মের বহুমুখী স্টিলথ জঙ্গিবিমান প্রকল্প থেকে বের করে দিয়েছে এবং উন্নত কোনো সামরিক প্রযুক্তিই দিচ্ছে না, যদিও তুরস্ক পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর অন্যতম প্রধান অংশীদার। তুরস্ক হচ্ছে ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহৎ সামরিক শক্তি, যা মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ধরে রাখতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্র শুধু বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাশক্তিই নয়, সাম্রাজ্যবাদী কিংবা আধিপত্যবাদী ধ্যান-ধারণারও শীর্ষস্থানীয় প্রতিভূ। তাই যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব কিংবা তুরস্কের মতো মুসলিমপ্রধান সুন্নি অধ্যুষিত দেশকে শিয়া অধ্যুষিত ইরান কিংবা চীন ও রাশিয়ার হাতে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব, তুরস্ক ও অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশকে আশ্বাস দিয়েছে যে তারা যদি ইসরায়েল নামের ইহুদি রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করে আনতে রাজি থাকে, তাহলে তাদের প্রার্থিত উন্নত সামরিক প্রযুক্তি, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিংবা যুদ্ধবিমান দেওয়া সম্ভব হতে পারে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব, তুরস্কসহ মুসলিম বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্রের সুস্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে, ফিলিস্তিন সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সমাধানের আগে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ কিংবা বলিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব নয়। তাদের সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি বিবেচনায় রেখেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সামনে এগোচ্ছিলেন। কিন্তু এখন তাতে রাজি নন নেতানিয়াহু। কারণ ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হলে নেতানিয়াহু ও তাঁর ডানপন্থী বা কট্টরপন্থী ইহুদিদের পরিকল্পিত জর্দান নদীর পশ্চিম তীর থেকে ভূমধ্যসাগরের উপত্যকা পর্যন্ত একটি বৃহত্তর ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন কোনোমতেই বাস্তবায়িত হবে না।
গত বছরের ৮ অক্টোবর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজায় হামাসসহ অন্যান্য প্রতিরোধ বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইরান, তুরস্ক, সৌদি আরব, মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে একটি অলিখিত চুক্তি বা সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন যে সেই যুদ্ধ কোনোমতেই গাজার বাইরে কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ছড়াবে না। সে কারণে এবং মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি এবং যুদ্ধবিমান পাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে উপরোল্লিখিত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো গাজা কিংবা পশ্চিম তীরসহ ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এখনো সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে অস্ত্র ধরছে না। বর্তমান অবস্থায় ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী মুসলিমপ্রধান দেশগুলো যৌথভাবে অস্ত্র ধরার সিদ্ধান্ত নিলে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা কিংবা আগ্রাসন বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তারা সেটি না করে মৌখিক বা বাগযুদ্ধের এক অসার কৌশল অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
তা ছাড়া হামাস, হিজবুল্লাহ কিংবা হুতি-আনসারাল্লাহ ইরানের সমর্থনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের ‘প্রক্সি ওয়ার’ চালিয়ে গেলেও ইরান এখনো সরাসরিভাবে চলমান যুদ্ধে অংশগ্রহণের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। কারণ ইরান মনে করে, এই চলমান যুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করলে আনুষ্ঠানিকভাবেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। ইরান মনে করে, বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি কিংবা বিশ্বব্যবস্থা সে জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। তবে এর মধ্যেও পশ্চিমা অর্থাৎ বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোসহ বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে উত্তরোত্তর তাদের মতামত ব্যক্ত করে যাচ্ছে।
উপরোল্লিখিত সে পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব এখন চরমে পৌঁছেছে। এরই মধ্যে ইসরায়েলের সাবেক সেনাপতি ও নেতানিয়াহুর যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য বেনি গাঞ্জ পদত্যাগ করেছেন। তিনি অবিলম্বে ইসরায়েলে একটি সাধারণ নির্বাচন ডাকার আহ্বান জানিয়েছেন। যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় শেষ পর্যন্ত নেতানিয়াহুর বিরোধিতা যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে জো বাইডেনের পরাজয় যেমন নিশ্চিত করতে পারে, তেমনি নেতানিয়াহুকেও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার পথ রুদ্ধ করতে পারে। এই আশঙ্কা আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষকদের। এমন একটি পরিস্থিতিতে বিশ্ববাসী ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছে।
ইসরায়েল নামের মধ্যপ্রাচ্যের একটি ক্ষুদ্র ইহুদি রাষ্ট্র এখন সত্যিকার অর্থেই সমগ্র বিশ্বের শান্তির বিপক্ষে বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধি পরিষদ কিংবা ইসরায়েল ও নেতানিয়াহুর সমর্থকরা স্বার্থপরের মতো যত কথাই বলুক না কেন, সেগুলো সমগ্র বিশ্ববাসীর শান্তির প্রত্যাশা কিংবা তাদের নিজ অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলছে। কারণ এক নেতানিয়াহুর জন্য একটি বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে শেষ পর্যন্ত কার স্বার্থ উদ্ধার হবে—এই প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।