‘আপনি কি কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাতে চান? কোথায় করাবেন, কার মাধ্যমে করাবেন, ডোনার পাবেন কোথায়—এসব নিয়ে আর ভাবনা নয়, আমরা প্যাকেজের ভিত্তিতে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের সব কাজ করে থাকি।’
রাজধানীর মিরপুরের দরজি রবিন খানকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে দালালচক্র ভারতে নিয়ে তাঁর একটি কিডনি কেটে নেয়। এই ঘটনায় ধানমণ্ডি থানায় মামলা করেন তিনি। সম্প্রতি ওই মামলার তদন্তে নেমে কিডনি বেচাকেনার দালালচক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ধানমণ্ডি থানার পুলিশ।
তাঁদেরই একজন আতাহার হোসেন বাপ্পিকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর ফেসবুক মেসেঞ্জারের মেসেজে কিডনি কেনাবেচার এমন তথ্য পায় পুলিশ।
ওই মেসেজে আরো বলা হয়, ‘বাংলাদেশে নন-রিলেটিভ ডোনার দিয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করানো যায় না। যাঁদের রিলেটিভ ডোনার নেই, তাঁদের বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে ট্রান্সপ্লান্ট করাতে হবে। আমরা ডোনার ও অ্যাটেনডেন্ট, বাংলাদেশের লিগ্যাল পেপার, পাসপোর্ট, ভিসা, কলকাতার সব টেস্ট, কলকাতার লিগ্যাল পেপার তৈরি, বোর্ড মিটিংসহ ওটি পর্যন্ত সব কাজে সহযোগিতা করে থাকি।
আপনারা যাঁরা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাতে চান, তাঁরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আমাদের কথার সঙ্গে কাজের শতভাগ মিল পাবেন।’গ্রেপ্তার দালালচক্রের আরেক সদস্য রাজু হাওলাদারের ফেসবুক মেসেঞ্জার পরীক্ষা করেও একই ধরনের তথ্য পায় পুলিশ। তাঁর মেসেঞ্জারে এক নারীকে উদ্দেশ করে লেখা হয়, ‘ম্যাডাম, আমার এক বন্ধু এই কাজ করে।
আপনার পরিচিত কেউ থাকলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।’
কিডনি কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত দালালচক্র এভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনলাইনে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের প্রচারণা চালাচ্ছে। যদিও আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে, মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯-এর ৯ ধারায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন-২০১৮ অনুযায়ী ২২ ধরনের নিকটাত্মীয় কিডনি রোগীর জীবন রক্ষায় নিজের একটি কিডনি দিতে পারবেন। ওই তালিকার বাইরে অন্য কারো শরীর থেকে কিডনি নিয়ে আরেকজনের শরীরে প্রতিস্থাপনের আইনি সুযোগ নেই।
আইনে আরো বলা আছে, কেউ যদি নিকটাত্মীয়ের বাইরে অন্য কারো কিডনি প্রতিস্থাপন করে তাহলে তাকে তিন থেকে সাত লাখ টাকা জরিমানাসহ সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। একই সঙ্গে যে হাসপাতালে অবৈধভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হবে ওই হাসপাতালের রেজিস্ট্রেশন নবায়ন বাতিল করা হবে। অবৈধভাবে কিডনি কেনাবেচা বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় এই বাণিজ্য অব্যাহত আছে। অনেক ক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের মানুষ দালালচক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
দেশে ঠিক কতসংখ্যক কিডনি কেনাবেচার দালালচক্র রয়েছে, তার সঠিক তথ্য না থাকলেও সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, অন্তত ২২টি কিডনি বেচাকেনার দালালচক্র দেশে সক্রিয়। এর মধ্যে প্রথম দলটি রাজধানীতে অবস্থান করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিত্তশালী যেসব রোগীর কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। দ্বিতীয় দলটি প্রথম দলের চাহিদা অনুযায়ী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অভাবী মানুষকে চিহ্নিত করে প্রতারণার মাধ্যমে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের ডোনার হতে ঢাকায় নিয়ে আসে। আর তৃতীয় দলটি অর্থের বিনিময়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিডনি ডোনারদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করায়।
ডায়াগনস্টিক টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তির পাসপোর্ট, ভিসা করে তাকে ভারতে পাঠানো হয়। সেখানে আরেকটি চক্র কিডনি ডোনারকে এয়ারপোর্ট বা স্থলবন্দর থেকে নিয়ে যাওয়া থেকে হাসপাতালের ডকুমেন্টেশন, কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের অস্ত্রোপচারসহ সব কাজ শেষ করে ফের দেশে পাঠিয়ে দেয়।
কিডনি বিক্রি চক্রের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খন্দকার মহিদ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, এই চক্রের সদস্যরা মূলত যারা আর্থিক অনটনে আছে তাদের টার্গেট করে। এরপর কৌশলে তাদের কাছ থেকে কিডনি নিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে। ভারতেও এই চক্রের সহযোগী থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। চক্রের সদস্যরা দরিদ্র মানুষকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাশের দেশে (ভারতে) নিয়ে যায়। সেখানে জিম্মি করে অর্থের প্রলোভনসহ নানা কৌশলে হাতিয়ে নেয় কিডনি। এসব কিডনির গ্রহীতারা বাংলাদেশি। বিশেষ করে চক্রটি কলকাতা ও গুজরাটে সক্রিয়।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ আরো জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া চারজন একটি চক্রের সদস্য। এই চক্রে ১০ থেকে ১২ জন দালাল রয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন ভারতে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের দালালরা ভারতের কিডনি বিক্রি চক্রের দালালদের সঙ্গে যোগসাজশে এই কাজ করেন। প্রতিটি কিডনি বিক্রির মধ্যস্থতা করে এঁরা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এঁদের ফাঁদে পড়ে অনেকে কিডনি হারিয়েছেন।
র্যাবের তদন্তে জানা গেছে, শুধু রাজধানীতে নয়, জয়পুরহাট, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটসহ দেশের আরো কিছু এলাকায় এই দালালচক্র রয়েছে।
সূত্র মতে, কিডনি বিক্রির ঘটনায় গত ১৩ বছরে দেশে ৪৫টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় ১৩৭ জনকে আসামি করা হলেও বেশির ভাগ এখনো ধরা পড়েনি।
কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুন-অর-রশিদ বলেন , ‘কিডনি প্রতিস্থাপনের ৩০ শতাংশ হয় জীবিত নিকটাত্মীয় থেকে আর ৭০ শতাংশ হয় ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে। বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামী দেশ, বিশেষ করে সৌদি আরব, ইরান ও কুয়েতে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট করা হচ্ছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ বলেন , সাধারণত নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয় ডোনার প্রকৃত অর্থেই রোগীর আত্মীয় কি না। কিন্তু পাশের দেশের কয়েকটি হাসপাতাল আছে, মধ্যস্থতাকারী একটি চক্র এসব হাসপাতালে বাংলাদেশ থেকে কিডনি পাচার করে কিংবা সেখানে ডোনার নিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করে। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ।