ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিচার বিভাগ এবং সরকারের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব কমানোর চেষ্টা চলছে। রায় ও পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে রিভিউ করতে যাচ্ছে সরকার। সেজন্য আরো বেশ কিছু দিন সময় নেয়া হতে পারে। তবে রিভিউয়ের আগ পর্যন্ত বিচার বিভাগের ওপর নানামুখী চাপ অব্যাহত রাখা হবে। আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সূত্রগুলো জানায়, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় ও পর্যবেণ নিয়ে প্রধান বিচারপতির সাথে সমঝোতার জন্য একাধিক বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর বিকল্প পথ নিয়েই ভাবছিল সরকার। সেজন্য প্রধান বিচারপতির ‘অসদাচরণ’ ও ‘শপথ ভঙ্গ’ প্রমাণে বেশ কিছু অভিযোগ জোগাড় করে সরকার। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত একজন আসামির পরিবারের সাথে বৈঠক, আবেদনকারীর অনুরোধে আপিল বিভাগের বেঞ্চ পরিবর্তনসহ প্রধান বিচারপতির বিভিন্ন বক্তব্যের অডিও এবং ভিডিও জোগাড় করা হয়। এমন প্রেক্ষাপটে শেষ চেষ্টা হিসেবে গত মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতির সাথে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আর এ বৈঠকের পরই পাল্টে যায় দৃশ্যপট।
সরকারের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ওই বৈঠকে রায়ের পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহারের (এক্সপাঞ্জ) ব্যাপারে খানিকটা সমঝোতার আভাস মেলে। তবে সেজন্য সুয়োমুটো নয়, সরকারকে রিভিউ আবেদন করার শর্তও আসে। ফলে সরকারও রিভিউর কথা ভাবছে। সেই লক্ষ্যে রায়ের প্রতিটি শব্দ পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করছেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র আইনজীবী নেতারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘আমরা আদালতের রায় নিয়ে কোনো কথা বলিনি এবং বলবও না। কিন্তু রায়ে পর্যবেণের নামে যেসব অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে আমরা কথা বলছি এবং আগামীতেও বলব। কারণ, এগুলোর সাথে স্বাধীনতার ইতিহাস জড়িত, দেশের মানুষের মূল্যবোধ জড়িত। সেজন্য আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করে পুনর্বিবেচনার আবেদন করব।’ রিভিউ করলে আবার আওয়ামী লীগ প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ চায় কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ চাই না।’
দলের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের একটি বিজ্ঞ আইনজীবী টিম রায়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করছেন। রায় পর্যালোচনা শেষে আমরা রিভিউ করব। তবে এত বড় রায়ের প্রতিটি শব্দ পড়তে অনেক সময় প্রয়োজন। সেজন্য একটু সময় লাগতে পারে।’
জানা গেছে, ষোড়শ সংশোধনীর রায় ছাড়াও অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির বিধিমালাসংক্রান্ত আইন এবং নির্বাহী বিভাগের কাছ থেকে ম্যাজিস্ট্রেসি মতা কেড়ে নেয়াকে কেন্দ্র করে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্বে প্রধান বিচারপতির ওপর সরকারের অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে চরম বিবাদে জড়ায় সরকার ও বিচার বিভাগের শীর্ষ পর্যায়। গত ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ইস্যুটি নিয়ে সমঝোতার আশা থাকলেও পরদিন সে আশায় চিড় ধরে বলেই উচ্চপর্যায়ে বৈঠক করা হয়।
আর গত রোববার প্রধান বিচরপতির দেয়া ‘আমরা চরম ধৈর্য ধরছি এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকেও আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে’ এমন বক্তব্য সরকারকে চরমপন্থার দিকে ধাবিত করে। ফলে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে বিকল্প ভাবনাই নীতিনির্ধারকদের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছিল। সে বিষয়টি মাথায় রেখে ‘গ্রাউন্ড ওয়ার্ক’ও সারছিলেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। তারই অংশ হিসেবে প্রধান বিচারপতির সাথে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের গোপন বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করেন ওবায়দুল কাদের।
পরে গত ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করেন। এ বৈঠকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ছাড়াও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও উপস্থিত ছিলেন।
সূত্রমতে, ষোড়শ সংশোধনীর রায় ও পর্যবেণ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে ওই বৈঠকে। জানা গেছে, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে প্রধান বিচারপতি যেসব পর্যবেণ দিয়েছেন, অথবা সম্প্রতি যেসব বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে স্বীয় পদে থেকে বিচারপতি তার শপথ ভঙ্গ করেছেন কি না, সে বিষয়ে রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে ওই বৈঠকে। এ ছাড়া ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, তা নিরসনে রাষ্ট্রপতি সমাধান দিতে পারেন কি না, তা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয় বৈঠকে।
সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চপর্যায়ে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ নিয়েও বিস্তর আলোচনা চলছে। তবে এসব পদ্ধতি অনুসরণ করার প্রয়োজন পড়লে সে ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া কী হয়, তা নিয়েও ভাবা হচ্ছে। এসব পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে পরবর্তী পরিস্থিতি আরো বেশি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে কি না, তা বুঝে ওঠার চেষ্টা চলছিল সরকারের ভেতরে। এমন প্রেক্ষাপটে গত মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতির সাথে শেষ চেষ্টা হিসেবে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী।
আর সেই বৈঠকেই সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ এ বৈঠকের পরদিন গত বুধবার রাষ্ট্রপতির সাথে বঙ্গভবনে গিয়ে দেখা করেন আওয়ামী লীগ উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এবং বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তারা সেখান থেকে আবার গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথেও দেখা করেন। ফলে প্রধান বিচারপতি ও সরকারের মধ্যকার দূরত্ব খানিকটা কাটতে শুরু করে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সেই দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘আদালতের রায় নিয়ে বিএনপি ধরেই নিয়েছে বিজয়ের পথ বুঝি সুগম হলো। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে বিএনপির মতায় যাওয়ার স্বপ্ন ভণ্ডুল হয়ে গেছে।’
অন্য দিকে প্রধান বিচারপতিও বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আমার বক্তব্য নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। আমি কোর্টে যা বলি তার কিছু ‘ডিস্টরটেড’ করা হয়। এতে আমাকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। এমন অবস্থায় আমাকে যাতে না পড়তে হয়, সেই বিষয়ে খেয়াল রাখবেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার পে প্রেস কনফারেন্স করে কোনো কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে বিচারক হিসেবে কোনো মামলার শুনানির সময় আইনজীবীকে প্রশ্ন করতেই পারি। এটি আমার স্বাধীনতা। প্রশ্নটি কী কারণে এবং কোন উদ্দেশ্যে করা, সেটি না বুঝে এটি (উদ্ধৃতি) করায় অনেক সময় ভুলভ্রান্তি হয়। এটি একটু খেয়াল রাখবেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন নীতিনির্ধারক বলেন, ‘ইস্যুটি নিয়ে সমঝোতার রুদ্ধ পথ নতুন করে খুলতে শুরু করেছে। সেজন্য প্রধান বিচারপতি তার অবস্থান বদলে উল্টো সাংবাদিকদের সতর্ক করেছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যও সেটাই প্রমাণ করে।’
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে আওয়ামী লীগ রিভিউ করলেও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। এটি সরকারের আরেকটি রাজনৈতিক কৌশল।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, ২৫ আগস্ট ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এস