বাঙালি জাতির কল্যাণ কামনায় অবিরাম ছুটে চলা রাজনৈতিক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির ওপর অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন আমৃত্যু। পাকিস্তানে স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলা ও বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। জেল, জুলুম, নির্যাতন ও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছেন তিনি। তার নেতৃত্বেই অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ ও দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধের কারণে ঠাঁই করে নেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু যে আদর্শ অনুকরণ করতেন, বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজও সেই চেতনা ধারণ করেই টিকে আছে পুরো বাঙালি জাতি। আজ ১৭ মার্চ, আমাদের স্বাধীনতার রূপকার অবিসংবাদিত মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মদিন। ১৯২০ সালের এই দিনেই গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এই খোকার জন্মদিন ছিল বাঙালির এক শুভক্ষণ। কারণ, সেই খোকা, শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের দিয়েছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। তার নেতৃত্বে হাজার বছরের ইতিহাস পার হয়ে বাঙালি জাতি বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্র পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির পিতা।
বঙ্গবন্ধু জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন, বাঙালির মুক্তির জন্য নিজকে উৎসর্গ করা। ধাপে ধাপে প্রতিটি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৪৮ থেকে ’৫২ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন; ’৫০ থেকে ’৫৪ জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ; ’৫৪ থেকে ’৫৬ সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসন; ’৬৪ তে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতা; ’৬৬তে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্থাৎ স্বাধিকার তথা ৬ দফা; ’৬৯-এর গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকূপ থেকে মুক্তমানব হয়ে বেরিয়ে এসে সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি এবং সংখ্যাগুরুর অধিকার আদায়; ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ভূমিধস বিজয় অর্জন ও পরিশেষে ’৭১-এ স্বাধীনতার ডাক দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক এই পর্বগুলো সংঘটনে তাকে জীবনের ১৩টি বছর কারান্তরালে কাটাতে হয়েছে। মূলত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই বঙ্গবন্ধু নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। বারবার ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। পুরো রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সময়পোযোগী। কখনই অন্যায়ের কাছে নিজে মাথা নত করেনি। তিনি চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন। একবার যে সিদ্ধান্ত নিতেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হলেও আপস করতেন না।
দেশের ভাগের পর পরই নানামুখী নির্যাতনের শিকার হতে থাকে বাঙলিরা। সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় বাঙালিদের। ঠিক সেই সময় পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সঞ্চারিত করেছিলেন স্বাধীনতার প্রবল স্পৃহা। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বপ্ন দিয়ে, মানুষকে সংগঠিত করে, লক্ষ্যে অবিচল থেকে এবং ত্যাগ স্বীকার করে। এ জন্য অসম্ভব কষ্ট স্বীকার করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, কিন্তু লক্ষ্য থেকে কখনো সরে যাননি। তার জীবনের বহু বছর কেটেছে কারান্তরালে। মুচলেকার বিনিময়ে গোয়েন্দাদের কারাগার থেকে মুক্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন বারবার। বলেছেন, তিনি জীবন দেবেন কিন্তু বাংলার মানুষের মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম থেকে বিরত থাকবেন না। বঙ্গবন্ধু রক্ত দিয়ে মানুষের ভালোবাসার ঋণ শোধ করেছেন। কিন্তু তার কাছে আমাদের যে ঋণ, তা শোধ হবে কী করে? হবে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর মধ্য দিয়ে; গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আন্দোলন, সংগ্রাম ও বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠায় একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আগরতলা মামলায় ক্যান্টনমেন্টে বন্দি থাকার সময় তাকে পেছন থেকে গুলি করে মারার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তথ্য পেয়ে তিনি সাবধান হয়ে যান। সার্জেন্ট জহুরুল হক সেই বন্দিশালায় শহীদ হন। আগরতলা মামলায় তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পরিকল্পনাই করেছিলেন পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান। কিন্তু বাংলার মানুষ ঊনসত্তরের বীরোচিত গণআন্দোলন গড়ে তুলে তাকে মুক্ত করে আনে। তাকে ভালোবেসে উপাধি দেয় ‘বঙ্গবন্ধু’। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে তাকে প্রচণ্ড গরমে নিঃসঙ্গ সেলের মধ্যেই কেবল বন্দি করে রাখা হয়নি, তার শাস্তি সাব্যস্ত করে রাখা হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে এগিয়েছেন নির্ভুলভাবে, ধাপে ধাপে। তিনি ছয় দফা ঘোষণা করেছেন, ইয়াহিয়া খানকে নির্বাচন দিতে বাধ্য করেছেন। তিনি জানতেন, নির্বাচনে তিনি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের বহু আগেই বাঙালির অন্তরে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার লক্ষ্যে একের পর এক গড়ে তোলেন আন্দোলন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু অসহযোগের ডাক দেন। ৭ মার্চ অবিস্মরণীয় এক ভাষণে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অবস্তুগত বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত সেই ভাষণ ছিল একই সঙ্গে কাব্যময় এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার এক অনন্য উদাহরণ। এই ভাষণের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা দেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশনা দেন। তিনি মুক্তি ও স্বাধীনতার আহ্বান জানান।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যন্য ও অসাধারণ রাজনীতিবিদ। সবসময় ছোটকে বড় করে তুলতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন হৃদয়বান এক মহান নেতা। কারও দুঃখ তিনি সহ্য করতে পারতেন না। পরকে সহজেই আপন করে নিতেন। যারা বিরোধী ছিলেন তাদের কাছে টেনে নিতেন। তিনি যখন বলতেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না’, মানুষ তাই বিশ্বাস করত। তিনি ক্ষমতার জন্য, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করেননি। প্রিয় মাতৃভূমিকে শোষণ-বঞ্চনার নাগপাশ থেকে রক্ষা করে বাঙালিরা যাতে বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পারে সে জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে রাজনীতি করেছেন। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজও বঙ্গবন্ধুর চেতনা টিকে আছে বাঙালির হুদয়ে এবং আন্তরে। এদিকে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মদিন এবং জাতীয় শিশু দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার জন্মদিন ও দিবসটি পালনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন সমূহ।