আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী দল বিএনপি ও সমমনারা আসন্ন ভোট প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে আসছে। প্রশাসনসহ সর্বস্তরের জনগণকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে হরতাল, অবরোধসহ নানা কর্মসূচি।
এদিকে সব আসনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরোধ চরমে পৌঁছায় পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে ওঠছে দিনকে দিন। এমন প্রেক্ষাপটে ভোটের আগে নির্বাচনী পরিবেশ যাতে প্রতিক‚ল না হয়ে ওঠতে পারে সে বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানে বহুমুখী চ্যালেঞ্জে পড়া নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করতে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি ‘ডিটারমাইন্ড’ (প্রতিজ্ঞাবদ্ধ)। এজন্য কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রিটার্নিং কর্মকর্তা, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রয়োজনী নির্দেশনা দিয়ে তা প্রতিপালনের ওপর জোর দিচ্ছেন। সেইসঙ্গে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী ও ভোটারদের আইনী পদক্ষেপে গ্রহণের বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলছেন না। ভোটে চ্যালেঞ্জ যত বাড়ছে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইসির কঠোরতাও। এরইমধ্যে ভোট প্রতিহত করার চেষ্টাকারীদের জেল-জরিমানা এবং তাদের মোকাবিলায় পুলিশকে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের আচরণবিধি ভাঙলে প্রার্থিতা বাতিল করে দেয়ার হুমকি এবং কারচুপি করার চেষ্টা করা হলে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের।
এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল গতকাল বরিশালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতেই হবে। এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই কম্প্রমাইজ করা যাবে না। পুলিশকে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। শেষ ভালো যার সব ভালো তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, আসল দিনটা হচ্ছে ৭ জানুয়ারি পোলিং ডে। আল্টিমেটলি যে জিনিসটা মূল্যায়ন হবে সেটি হলো পোলিংটা কেমন সুদ্ধ, সিদ্ধ পরিশুদ্ধ হলো। বিষয়টি মাথার রাখার জন্য আমি বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারদের বলেছি। সুতরাং পোলিং ডে-তে যেন বিন্দুমাত্র অনিয়ম না হয়। ভোটকেন্দ্রে যেন ভোটাররা অবাধে এসে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে পারেন, সেই নিশ্চয়তাটা লাগবে। পুলিশের কর্মকর্তাদের প্রিভেনটিভ ক্যাপাবিলিটি (প্রতিরোধ ক্ষমতা) বাড়ানোর চেষ্টা করতে বার বার বলেছি। ঘটনা ঘটে গেলে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছি, ট্রেনের বগিতে আগুন লাগুক তারপর গ্রেপ্তার করেছি, এটা নয়। আমি চাই না ট্রেনে আগুন লাগুক, কোনো সহিংসতা ঘটুক। আমি চাই না কারও মৃত্যু ঘটুক। তারাও (পুলিশ প্রশাসন) এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে এবং চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ভোট প্রতিহতের চেষ্টা করা হলে জেল: ভোট প্রতিহত করার চেষ্টা করা হলে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে কমিশন।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ভোট প্রতিহত করার অধিকার কারও নেই। কেউ প্রতিহত করার চেষ্টা করলে সাত বছরের জেল হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটকে যথাযথ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্বাচন ভবনে গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, মাঠেও একই কথা বলেছি। কেউ ভোটে নাও আসতে পারেন, ভোট দিতেও নাও পারেন। ভোট প্রতিহত করার অধিকার কারও নাই। কিন্তু অন্যকে প্রতিহত করলে আমরা এবার সংশোধনী এনেছি যে সাত বছর পর্যন্ত জেল বা অর্থদণ্ড করার জন্য। পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট সবাইকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। আনিছুর রহমান বলেন, দায়িত্ব অবহেলা করলে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকেই আমরা ছাড় দেব না। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে এই কমিশনার আরও বলেন, ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য লিফলেট বিতরণ হলে চোখে পড়লেই ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে হেভি ওয়েট কা লাইট ওয়েট বলে কেউ নেই। যার বিরুদ্ধ অভিযোগ আসবে তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেউ শোডাউন করতে পারবে না। উৎসবমুখর ভোট থাকবে।
কারচুপি হলেই ভোট বন্ধ: কোনো ধরনের কারচুপি হলে তাৎক্ষণিকভাবে ভোটগ্রহণ বন্ধেও নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ বিষয়ে বলেন, অনেকেই বিশ্বাস করেন ভোট হলেও রিটার্নিং কর্মকর্তা একজনকে জয়ী ঘোষণা করে দেবেন। এগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়। এমনকি এটা কখনোই সম্ভব না। আর ঘোষণা তো দূরের কথা একটি ভোটও যদি কারচুপি হয় তাহলে তাৎক্ষণিক ওই কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করা হবে। তিনি বলেন, বিগত ৫০-৬০ বছরের নির্বাচনের ইতিহাসে আমরা দেখেছি প্রচারণার সময় অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনা ঘটে। এবার নির্বাচন কমিশন থেকে প্রশাসনকে স্পষ্টভাবে বার্তা দিয়েছি এই বিষয়গুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। একই সঙ্গে প্রার্থীদের প্রতি আবদার হচ্ছে আপনারাই নির্বাচনের মাঠকে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ রাখবেন। সিইসি বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা ভোট পাল্টাতে পারেন না। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ফল ঘোষণা হয়। প্রার্থীরা ঘরে বসেই জানতে পারেন ফলাফল। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ভোট করতে বিদেশিরা তৎপর রয়েছে। এজন্য প্রার্থীদের কাছে সহযোগিতা চাচ্ছি। আপনাদের বলব সিস্টেমের ওপর আস্থা রাখুন। ভোটারদের ভোট দিতে হবে, অন্য কেউ তাদের ভোট দিয়ে দেবে এটা হবে না।
সহিংসতা প্রতিহত করা হবে: ভোটকে ঘিরে সহিংসতা প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছে ইসি। এ বিষয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, দুই-একটি ঘটনাকে খুব বেশি বড় করে দেখা ঠিক হবে না। কিন্তু অবশ্যই ঘটনাগুলোকে প্রতিহত করতে হবে, তা না হলে মাননুষের মাঝে আস্থা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মাদারীপুরের কালকিনিতে নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সিইসি বলেন, দুই দিন আগে ফরিদপুরের একটি ঘটনা শুনে সঙ্গে সঙ্গে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ থেকে তথ্য নিয়েছি এবং ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে তথ্য নিয়ে আমরা চট করে কোনো শাস্তি দিতে পারি না। আমরা এই তথ্যও সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নেব। তবে সেটি আমাদের নিয়মানুযায়ী তদন্ত করে নেব। আপনারা আশ্বস্ত থাকুন যে ঘটনা ঘটছে, তা আমরা পর্যবেক্ষণ করছি।
প্রার্থীদের বিষয়ে কাজী হাবিুল আউয়াল বলেন, প্রার্থীদের আমি বলেছি, তারা যেন অবশ্যই সব জায়গাতে পোলিং এজেন্ট দেন। এটা বিশ্বের সব জায়গাতে অনুসৃত পদ্ধতি। তারাই একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করবেন। কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি না, কিংবা কোনো শক্তিশালী পক্ষ অর্থ বা পেশি শক্তি ব্যয় করে কোনো অনিয়ম করছে কি না, সেটা প্রতিহত করতে হবে প্রথমে পোলিং এজেন্টকে। পোলিং এজেন্টকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে কমপ্লেইন করতে হবে। আর প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট না থাকলে নির্বাচনে ভারসাম্য সৃষ্টি না হলে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পরেও প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।
প্রার্থিতা বাতিলের হুঁশিয়ারি: নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন কিংবা সহিংস ঘটনা ঘটালে যেই হোক না কেন কোনো ছাড় নয়। প্রার্থিতা বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন ভবনে গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান এ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, কোনো শঙ্কা, ভয়-ভীতি বা আনুক‚ল্য নেই। প্রার্থিতা বাতিল হবে, কোনো না কোনো জায়গায় কারও না কারও, এইটুকু আভাস আমি দিয়ে রাখলাম। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কেন মাঠ দাঁড়াতে পারছে না, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের কেন আচরণবিধি মানাতে পারছেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, আমরা পারছি না, এতে একমত হতে পারছি না, এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলা ঘুরে আসছি। আচরণ বিধি বাস্তবায়ন হচ্ছে। আজকেও আমরা কিছু কঠোর সিদ্ধান্তের আলোচনা করেছি। আরও কিছু তথ্য চেয়েছি। আগামীকালকে পেলে দেখবেন যে কিছু কঠোর সিদ্ধান্তে চলে যাবো।
তিনি বলেন, একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক মারা গেছে। আমরা কঠোর সিদ্ধান্তে চলে যাবো। কোনো রকম ছাড় দেয়া হচ্ছে না। বড়-ছোট সবাইকে একইভাবে দেখছি। সেক্ষেত্রে আমরা নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মাঠে নিরপেক্ষ অবস্থান আছে। কোনো শঙ্কা, ভয়-ভীতি বা আনুক‚ল্য নেই। আমরা চরম নিরপেক্ষতার জন্য কেউ রেহাই পাবে না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যা করার দরকার করে যাবো। পুলিশ কেন অবেহলা করছে, এমন প্রশ্নের জবাবে সরকারের সাবেক এ সচিব বলেন, যেই ঘটনা শুনলাম এটা কিন্তু সকাল বেলা তিনি তার বাড়ি থেকে কোনো একটা জায়গায় যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে তাকে আক্রমণ করা হয়েছে। তারা উভয়েই একই বংশের, তাদের মধ্যে আত্মীয়তা রয়েছে। কিছুদিন আগেও তাদের মধ্যে একটা ঘটনা ঘটেছিল, সে কারণেই হয়েছে, নাকি নির্বাচনের কারণে হয়েছে এ বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। নির্বাচনের কারণে অনেকে ব্যক্তিগত শত্রæতার বিষয়টিও সামনে আনছে। আমরা নিরপেক্ষতার সঙ্গেই দেখবো। এখানে যে কারও মৃত্যুই অনাকাঙ্খিত। এভাবে মৃত্যু, একটা মৃত্যুও আমরা চাই না। এজন্য যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছি।
সংযত আচরণের তাগিদ: এদিকে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা জানিয়েছেন, নির্বাচন করতে গিয়ে কেউ যদি আচরণবিধি ভঙ্গ করে এবং সেটা প্রমাণিত হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা সর্বনি¤œ ২০ হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জরিমানা করতে পারি। চাইলে প্রার্থিতাও বাতিল করতে পারি। সিরাজগঞ্জের ৬টি সংসদীয় আসনের প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে গতকাল অনুষ্ঠিত মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
রাশেদা সুলতানা বলেন, আমি প্রার্থীসহ সবাইকে বলেছি, তাদের যে আইনগুলো আছে তারা যেন সেগুলো মেনে চলেন। প্রার্থীদের অভিযোগ ও সরকারি কর্মকর্তাদের ভোট চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগ তদন্তের বিষয়ে আমাদের নির্বাচনী কমিটি মাঠে কাজ করছে। সে ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ গেলে তারা সেটা তদন্ত করবেন। তদন্ত রিপোর্টগুলোও কমিশনে পাঠানো হয়। এগুলোর ক্ষেত্রে আমরা অনেক ব্যবস্থা নিয়েছি, আরও নেব। রাশেদা বলেন, আমরা সবাইকে সংযত হয়ে কাজ করার জন্য বলেছি। ভোটাররা যাতে ভোট কেন্দ্রে আসে, তারা যেন ভয় না পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।