ঘুমের মধ্যেই বাবা-মেয়ে খুন

রাজধানীর কাকরাইলে মা-ছেলে খুনের ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই বাড্ডায় আরও একটি রোমহর্ষক জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে। বাড্ডার হোসেন মার্কেটের পেছনে ময়নার বাগে ৩০৬ নম্বর চার তলা বাড়ির তৃতীয় তলায় নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন বাবা জামিল শেখ (৩৫) ও মেয়ে নুসরাত জাহান (৯)।

ঘুমন্ত অবস্থায় তাদের খুন করেছে দুর্বৃত্তরা। হত্যাকাণ্ডের পরপরই নিহতদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠিয়েছে পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে জামিল শেখের স্ত্রী আরজিনাকে (২৫) আটক করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় বিকালে বাড্ডা থানায় নিহতের বড় ভাই দুলাল শেখ হত্যা মামলা করেন। পুলিশ ও মামলার বাদী সূত্রে জানা গেছে, পরকীয়ার জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

তবে পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরজিনা জানিয়েছেন, জামিলের কিছু পরিচিত মানুষ টাকা লেনদেনের বিষয়ে কিছু দিন ধরে তাকে হুমকি দিচ্ছিল। গত রাতে চারজন বাসায় এসে তার স্বামী ও মেয়েকে হত্যা করে। তবে তাদের তিনি চেনেন না। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী সাংবাদিকদের জানান, প্রাথমিকভাবে ঘটনায় জামিলের স্ত্রীকে সন্দেহ করা হচ্ছে। তদন্তে ঘটনার মূল রহস্য বেরিয়ে আসবে।

বাড্ডা হোসেন মার্কেটের পেছনে ডান দিকের গলি দিয়ে সোজা পূর্ব দিকে ময়নার বাগের ৩০৬ নম্বর বাড়ি। চার তলা বাড়িটি ‘পাঠানবাড়ী’ নামে পরিচিত। বাড়ির পাশেই রয়েছে কবরস্থান ও মসজিদ।

গতকাল সকাল ১০টার দিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় অসংখ্য মানুষের ভিড়। বিলাপ করছেন নিহতের স্বজনরা। র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা ঘিরে রেখেছেন ঘটনাস্থল ও আশপাশ। সেখানে আছেন অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা। ঘটনাস্থল থেকে হত্যার বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করছেন তারা। খবর শোনার পরপরই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

এমন ঘটনার পর রীতিমতো যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসী। কারণ হিসেবে অনেকেই অনেক কিছু বলাবলি করছিলেন। ৩০৬ নম্বর ভবনের পাশের বাড়ির বাসিন্দা বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের গাড়িচালক লাল তুহিন জানান, তখন ভোর সাড়ে ৫টা। ফজরের নামাজ শেষে যে যার মতো বাসায় ফিরছিলেন। তিনিও ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে প্রস্তুত অফিসে যাওয়ার জন্য। বের হয়ে রাস্তায় এক মুসল্লির মুখে শোনেন পাঠানবাড়ীতে ঝামেলা হয়েছে। ওই বাড়ির তিন তলায় সপরিবারে থাকেন তার এলাকার বড় ভাই জামিল শেখ। খবরটি শুনে তার বুক আঁতকে ওঠে। ছুটে যান ময়নার বাগ কবরস্থান মসজিদের সামনে ঘটনাস্থলে।

তিনি বলেন, তৃতীয় তলায় জামিলের বাসায় গিয়ে দেখেন, বিছানার ওপর চাদরে ঢাকা অবস্থায় শুয়ে জামিল। পাশে তার মেয়ে নুসরাত। নাড়া দিয়ে দেখেন নিথর পড়ে আছে তাদের দেহ। আর বিছানার চাদর তুলে দেখেন জামিলের রক্তাক্ত লাশ। তখনো লাশের মাথা থেকে ঝরছিল তাজা রক্ত। এ সময় বাইরে বসে কাঁদছিলেন জামিলের স্ত্রী আরজিনা।

জানা গেছে, জামিল শেখের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের বনগ্রামে। আরজিনার বাড়ি পাশের গ্রাম বলগাঁয়ে। তাদের মেয়ে নুসরাত বাড্ডা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। জামিলের দুই কক্ষের বাসার একটিতে সাবলেট ভাড়া দেওয়া ছিল এক যুবকের কাছে। বুধবার রাতে যখন জামিলের ছোট ভাই ইব্রাহীম বাসায় খাবার খেয়ে বের হন, তখন তিনি ওই যুবককে দেখেছিলেন। কিন্তু খুনের ঘটনাটি জানাজানির পর ওই যুবকের ঘর তালা দেওয়া ছিল।

তুহিন এই প্রতিবেদককে জানান, বিছানায় নুসরাতের মাথার ওপর বালিশ চাপা দেওয়া ছিল। আর জামিলের মাথায় কাঠ আর ধারালো বঁটির একাধিক কোপের চিহ্ন পাওয়া যায়। ঘরের দেয়ালের সঙ্গে মাথা থেঁতলানোর দুটি চিহ্নও দেখেন তিনি। কিন্তু আরজিনার মুখে কোনো কথা ছিল না। অথচ ছিটিয়ে পড়া রক্ত ছিল তার সমস্ত শরীরে। তিনি যখন এসব দৃশ্য দেখছিলেন, এর কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুম থেকে ওঠে জামিলের পাঁচ বছরের সন্তান আলভী। সবকিছু বিবেচনা করে মনে হয়েছে, ঘুমন্ত অবস্থায় জামিলকে কোপানো হয়েছে। আর এই খুনের দৃশ্য দেখে ফেলায় নুসরাতকেও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। একই বাড়ির চতুর্থ তলায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন নাসিমা সুলতানা।

ইউসুফ নামে এক ব্যক্তি থাকেন তাদের সঙ্গে। ইউসুফ ফজরের নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার পথে সিঁড়ির কাছে বসে মুখে কাপড় চেপে আরজিনাকে কাঁদতে দেখেন। নামাজ শেষে বাসায় ফেরার পর তার মুখে এ বর্ণনা শুনে জামিলের স্ত্রীর কাছে সমস্যার কথা জানতে চান নাসিমা। কোনো উত্তর না পেয়ে তিনি ঘরে গিয়ে দেখেন বিছানার ওপর জামিলের রক্তাক্ত বীভৎস লাশ। পাশে নুসরাতের নীল বর্ণের ভয়ঙ্কর নিথর দেহ।

এসব দেখে তিনি বাইরে এসে চিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। জামিলের ভগ্নিপতি সালাউদ্দিন মহসিন জানান, ছয় মাস ধরে জামিল আর আরজিনার মধ্যে ঝামেলা চলছিল। ছেলে আলভীকে নিয়ে আরজিনা দীর্ঘদিন গোপালগঞ্জে বাবার বাড়িতে ছিলেন। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি জামিলের সংসার করবেন না বলে জানান। আত্মীয়স্বজনরা মীমাংসা করে দিলে আরজিনা ঢাকায় ফেরেন। ওই সময় ভাই দুলাল শেখের বাসায় থাকতেন জামিল ও মেয়ে নুসরাত।

বাংলাদেশ সময়: ১১২২ ঘণ্টা, ০৩ নভেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ

Scroll to Top