আশিতে পৌঁছে আর পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। ঝড়-ঝঞ্ঝা নিয়ে সমুদ্র পার হওয়ার পর আবার ফিরে নতুন করে সব কিছু শুরুর সময় পাওয়া যায় না। তবে জীবনে থেমে থাকা যাবে না। সৃষ্টি করে এগিয়ে চলতে হবে।
নিজের আশিতম জন্মবার্ষিকীতে এই উপলব্ধি আর পরামর্শ উচ্চারিত হলো শিল্পী, ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবীর কণ্ঠে।
চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় আয়োজিত জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বরেণ্য এই শিল্পী বলেন, ‘মনে হচ্ছে, একটা মহাসমুদ্র পার হলাম। একটা সমুদ্রে অনেক কিছুই থাকে। ঝড়-ঝঞ্ঝা থাকে, দ্বীপ থাকে, সেই দ্বীপে উত্তরণ ও নামার ব্যাপার থাকে। এই যাত্রা একেবারে সহজ-সরল ছিল না।’
এই দেশে অনেক কিছু নিয়ে লড়াই করতে হয় মনে করিয়ে দিয়ে শিল্পী আরো বললেন, ‘এসবের মধ্যে থেকেই কাজ করতে হয়। এসব থেকেই আমার কার্টুন ও অন্যান্য শিল্পের সৃষ্টি।’
শিল্পীর ভূয়োদর্শনজাত এই কথা যতটা আত্মোপলব্ধির ততটাই হয়তো নবীনদের জন্য অনুপ্রেরণা।
চারুকলা অনুষদের সবুজ আঙিনায় ছয় দশকের পথচলা রনবী নামে দেশজোড়া পরিচিত এই শিল্পসাধকের। প্রথমে অধ্যয়ন, তারপর অধ্যাপনা। তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনের বহু ঘটনার সাক্ষী এই প্রাঙ্গণ। গতকাল মঙ্গলবার তাই সেখানেই তাঁকে মধ্যমণি করে জড়ো হয় দেশের শিল্প-সংস্কৃতিজগতের মানুষ। সহকর্মী, সহযোদ্ধা, বন্ধু, ছাত্র, ভক্ত-অনুরাগীদের ফুল ও উপহারে উদযাপিত হলো তাঁর আশিতম জন্মবার্ষিকী।
কবি ও আবৃত্তিকাররা কবিতায়, সংগীত ও নৃত্যশিল্পীরা নাচে-গানে মাতিয়ে রাখলেন বকুলতলা। বিকেল ৩টায় শুরু হওয়া আয়োজন গড়ায় রাত অবধি।
এই আয়োজন শুরু হয় বিকেলে, চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে রফিকুন নবীর শিল্পকর্মের সপ্তাহব্যাপী বিশেষ প্রদর্শনীর উদ্বোধন দিয়ে। এই প্রদর্শনী তাঁর জীবনব্যাপী সম্পাদিত বিচিত্র ধরনের সৃজনকর্মের নিদর্শন নিয়ে। এতে রয়েছে টোকাইসহ অন্যান্য কার্টুন, পোস্টার, পত্রিকা ও বইয়ের প্রচ্ছদ, অলংকরণ ইত্যাদি। এই প্রদর্শনী চলবে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
রফিকুন নবীর ৮০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে চলতি মাসে এ নিয়ে মোট তিনটি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হলো। তার মধ্যে দুটির উদ্বোধন করা হয় গত ৫ নভেম্বর—একটি জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠিত তাঁর জীবনভর আঁকা চিত্রের প্রদর্শনী, অন্যটি ধানমণ্ডির গ্যালারি চিত্রকে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিককালে আঁকা চিত্রের প্রদর্শনী। এই দুটি প্রদর্শনী ছিল বিভিন্ন মাধ্যমে আঁকা তাঁর চিত্রকর্ম নিয়ে।
প্রদর্শনী উদ্বোধনের পর বিকেল ৪টায় শুরু হয় আনুষ্ঠানিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন ও আলোচনা পর্ব। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তি, সংগঠন, ভক্তরা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায় শিল্পীকে। কেউ কেউ অন্যান্য উপহারও শিল্পীর হাতে তুলে দেয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শিল্পী হাশেম খান, ড. আতিউর রহমান, ড. নজরুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সংস্কৃতিজন আসাদুজ্জামান নূর, রফিকুন নবীর স্ত্রী নাজমা বেগম প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গে পরে এসে যোগ দেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
অনুষ্ঠানে ‘উনসত্তুরে ছড়া’ নামের একটি বইয়ের নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালে বর্তমান চারুকলা অনুষদ ছিল সরকারি চারু ও কারু মহাবিদ্যালয়। এর ছাত্রসংসদের নামে বেরিয়েছিল গ্রন্থটি। এটির পরিকল্পনা ও অলংকরণ করেছিলেন রফিকুন নবী। বর্তমান সংস্করণে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার সংযুক্ত করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে জার্নিম্যান বুকসের অধিকারী কবি তারিক সুজাত ‘রশিদুন নবী : শিল্পেই যার আনন্দ’ নামের একটি বই রনবীর হাতে তুলে দিয়ে তাঁকে চমকে দেন। এই বইটি রনবীর পিতা রশিদুন নবীর ওপর লেখা। দুটি গ্রন্থেরই মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা।
আলোচনা পর্বে শিল্পী রফিকুন নবী বলেন, জয়নুল-কামরুলদের মতো বাংলাদেশের পথিকৃৎ শিল্পীরা শুধু চিত্র সৃষ্টির মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি; বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সৌন্দর্যবিষয়ক রুচির উন্নতি ঘটাতে আজীবন নিজেদের সচেষ্ট রেখেছেন। সাধারণ মানুষের শিল্পরুচিবোধ তৈরির কাজটি তাঁকেও করতে হয়েছে জানিয়ে শিল্পী বলেন, শিল্প সৃষ্টির পাশাপাশি মানুষকে সচেতনও করতে হয়েছে। এই কাজ তাঁরা করেছেন শিল্পের প্রতি মানুষের ভালোবাসা তৈরি করতে। অনুষ্ঠানে অন্য বক্তারা বলেন, শিল্পে নতুনতর গণভাষা দিয়েছেন রফিকুন নবী।
অবিস্মরণীয় কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই’-এর স্রষ্টা রনবী অনন্য প্রতিভায় দেশের শিল্পকলাকে ছাপিয়ে সামগ্রিক সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করে করেছেন। শত বছর তিনি সক্রিয় থাকবেন বলে প্রত্যাশা করেন বিশিষ্টজনরা।
অনুষ্ঠানটিকে আরো বর্ণাঢ্য করে তোলা হয় সাংস্কৃতিক পর্বের মাধ্যমে। এই পর্বে বিভিন্ন পরিবেশনা নিয়ে ছিলেন ছায়ানট, উদীচী, ভাস্কর, জলের গানের শিল্পীরা। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় আবৃত্তি করেন জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটি। আসিফ ইন্তাজ রবির একটি হাস্যরসাত্মক লেখা আবৃত্তি করেন শিমুল মুস্তাফা। প্রজ্ঞা লাবণী আবৃত্তি করেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের একটি কবিতা। রফিকুন নবীকে নিয়ে লেখা একটি ছড়া পাঠ করেন জাহিদ মোস্তফা।
১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জে রফিকুন নবীর জন্ম। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি একুশে পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত।