তফসিল ঘোষণা আগামী ১৩ নভেম্বর

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি এবং তফসিল ঘোষণা সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে আবহিত করতে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

আজ বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর ) দুপুর ১২টায় এই উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করতে বঙ্গভবনে যাচ্ছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। এতে চার কমিশনার, ইসি সচিবসহ কমিশনের কয়েকজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা অংশ গ্রহণ করবেন। বৈঠকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি, করে নাগাদ নির্বাচন তফসিল ঘোষণা করা হবে এবং নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখের বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করা হবে।

ইসি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিয়মানুযায়ী তফসিল ঘোষণার বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করতে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে বঙ্গভবনে যাচ্ছে পুরো কমিশন। তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে ভোট অনুষ্ঠানের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করা হবে। এরপর আগামী ১০ ও ১১ নভেম্বর জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) সাথে বৈঠক ও নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার অ্যাপ উদ্বোধনের কর্মসূচি রয়েছে ইসির। তাদের মতে, বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত টানা কর্মসূচি রয়েছে কমিশনের। এজন্য ১২ নভেম্বরের আগে তফসিল বিষয়ে কমিশন বৈঠক করা সম্ভবপর নাও হতে পারে। ওইদিন বৈঠক করে সময় নিয়ে ভাষণের খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। পরে সিইসির ভাষণ রেকর্ড করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)।

নির্বাচন কমিশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ১৩ নভেম্বরের আগে তফসিল ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা কম। ভাষণ রেকর্ডিংসহ এ সংক্রান্ত বেশকিছু কাজ থাকে কমিশনের। সেগুলো শেষ করে ১৩ কিংবা ১৪ নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে পারেন সিইসি। ওই ভাষণেই ঘোষণা করা হবে আসন্ন নির্বাচনের তফসিল। তবে এক্ষেত্রে ১৩ নভেম্বরকেই প্রাধাণ্য দিচ্ছেন অনেকে। তারা জানান, বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতার থেকে তফসিলের জন্য এই ভাষণ একযোগে প্রচার করা হবে। তবে বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও স্টেশনগুলো বাংলাদেশ টেলিভশন থেকে ফিড নিয়ে এই ভাষণ প্রচার করতে পারবে।

 

নির্বাচন কমিশন থেকে যদিও তফসিলের চূড়ান্ত তারিখ জানানো হয়নি তবুও আগামী সপ্তাহেই যে তফসিল ঘোষণা হবে সেবিষয়ে সন্দিহান নন কেউই। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম গতকাল বুধবার জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনে বদ্ধপরিকর কমিশন। এরইমধ্যে সব প্রস্তুতি গুছিয়ে আনা হয়েছে। এখন সম্পূর্ণরূপে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মতো পরিবেশ রয়েছে। তাই পূর্ব ঘোষিত সময়েই (নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে। জাহাংগীর আলম বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অত্যাসন্ন। সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। রেওয়াজ অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার আগে কমিশন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে। বৃহস্পতিবার (আজ) এ সাক্ষাতের সূচি রয়েছে।

তিনি বলেন, \’রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন প্রস্তুতি সংক্রান্ত সব ধরনের অগ্রগতি বিষয়ে অবহিত করা হবে। প্রস্তুতি নিয়ে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ ও নির্দেশনা থাকলে তা কমিশন শুনবে। তফসিল ঘোষণার এখতিয়ার সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের। তবে এ নিয়ে এখনো কমিশন সভা অনুষ্ঠিত হয়নি।\’

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী, সংসদের প্রথম অধিবেশন বসার দিন থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে ভোটগ্রহণ করতে হবে। এই হিসাবে ৯০ দিনের নির্বাচনের দিন গণনা শুরু হয়েছে ১ নভেম্বর থেকে। একই হিসাবে আগামী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ অবস্থায় দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভেদ থাকলেও নির্বাচন কমিশন সেই বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। নির্বাচন আয়োজনের যাবতীয় প্রস্তুতিও তারা গুছিয়ে এনেছে।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটা শেষের পথে রয়েছে। পাশাপাশি নির্বাচনি উপকরণ মাঠপর্যায়ে পাঠানোর প্রক্রিয়াও শুরু করেছে ইসি। চলছে বিভিন্ন ধরনের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ। পাশাপাশি সরকারি মুদ্রণালয়কে ব্যালট পেপারসহ অন্যান্য উপকরণ ছাপানোর নির্দেশনাও দিয়েছে কমিশন। এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে শেষবারের মতো সংলাপও সম্পন্ন করেছে ইসি। যদিও ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপিসহ ১৮টি দল অংশ নেয়নি সেই সংলাপে। যারা অংশ নিয়েছে, তাদের মধ্যেও বেশ কয়েকটি দল উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। তবে সেই আপত্তি আমলে নিচ্ছে না ইসি। বরং তারা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত সময় পার করছে।

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এই তফসিল আগামী সপ্তাহেই ঘোষণা করা হবে। সাধারণত তফসিল ঘোষণার দিন থেকে নির্বাচন পর্যন্ত ৪৫ থেকে ৬০ দিন সময় হাতে রাখা হয়। সে হিসাবে ১৩ বা ১৪ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা হলে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করার সম্ভাবনা বেশি।

ইসি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তফসিল নিয়ে দুই ধরনের চিন্তা রেখেছে ইসি। প্রথম তফসিল দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তা আবারও পরিবর্তন করা হতে পারে। এজন্য ভোটের বেশ কয়েকটি তারিখ চিন্তায় রেখেছে কমিশন। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ তথা ২৮ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণ; এ ক্ষেত্রে এ তারিখ আবার পরিবর্তন হতে পারে। এ ছাড়া ২ অথবা ৩ জানুয়ারি; ৭ অথবা ৮ জানুয়ারি এবং ৯ অথবা ১১ জানুয়ারিও ভোট গ্রহণের সম্ভাব্য তারিখ রাখার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে কমিশনের আনুষ্ঠানিক সভার ওপর। কমিশন সভায় নতুন তারিখও নির্ধারণ হতে পারে।

সংসদ নির্বাচনে সামনে রেখে \’স্পেস ও টাইম\’ সীমিত উল্লেখ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর বিবদমান সংকট নিরসনে নির্বাচন কমিশনের কোনো ম্যান্ডেট নেই। দলগুলোকেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সংকটের সমাধান করে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।

\’সময় ফুরিয়ে আসছে\’ উল্লেখ করে সিইসি বলেন, \’আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি, আমাদের স্পেস ও টাইমটা সীমিত। আমরা কিন্তু অনেক বেশি স্পেস নিয়ে কাজ করতে পারি না। আমাদের জন্য সময়সীমা সংবিধানে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আমাদের নির্বাচন করতে হবে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, নির্ধারিত পদ্ধতির মধ্যে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন হবে। আমরা সেই ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে অবস্থানে আছি।\’

সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ছয় কোটি সাত লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন, নারী ভোটার সংখ্যা পাঁচ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। এ ছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারের সংখ্যা ৮৫২ জন। নির্বাচনে মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ১০৩টি। ভোটকক্ষ রয়েছে দুই লাখ ৬০ হাজারের মতো।

 

ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে ইসির সংশ্লিষ্টরা জানান, সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে সমন্বিতভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে সভা করে থাকে ইসি। এবারই প্রথম পৃথক পৃথক আলোচনা করছে কমিশন। জাতীয় নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে মূল ফোকাসে থাকেন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানগণসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

 

প্রাপ্ত তথ্যমতে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতির মধ্যে ১ নভেম্বর নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংস্থার প্রধানদের নিয়ে সভা করেছে ইসি। এর আগে ৩০ অক্টোবর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সভা করে কমিশন। সভায় নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ মাথায় রেখেই নির্বাচনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।

 

নির্বাচন কমিশন থেকে তাদেরকে বলা হয়েছে, কিছুদিনের মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল ও অবরোধ চলছে। এতে নির্বাচনী কার্যক্রম যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচনী সকল মালামাল সঠিক সময়ে কীভাবে পৌঁছানো যায় তার পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া নির্বাচনে সংঘটিত অপরাধের বিচার, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভোটের মাঠে পর্যাপ্ত সংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেট রাখতে নির্দেশ দিয়েছে ইসি।

 

গত একাদশ জাতীয় সংসদের তুলনায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা এবার বাড়ানো হবে। জন-প্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর মনোনয়নপত্র জমার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শো-ডাউন থেকে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়, সেটা তদারকি করবে এই ম্যাজিস্ট্রেটরা। তবে প্রতীক বরাদ্দের পর মূল দায়িত্ব পালন শুরু করবেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। তিনশ সংসদীয় আসনের হিসাব করে প্রত্যেক ম্যাজিট্রেটকে কয়েকটি কেন্দ্রের দায়িত্ব দেয়ার কথা জানানো হয়েছে।

 

এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ডিসেম্বরের আগেই সকল পরীক্ষা শেষ করতে বলেছে ইসি। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নভেম্বরের মধ্যেই সকল পরীক্ষা শেষ করার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, ঋণ খেলাপি যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন সে বিষয়ে সিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নেবেন। আর তথ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নির্বাচনের যেকোনো প্রচারণার কাজ যাতে দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় সে ব্যবস্থা করবে তার মন্ত্রণালয়। পার্বত্য বা দুর্গম এলাকায় হেলিকপ্টারে নির্বাচনী মালামাল পরিবহনের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে পর্যাপ্তসংখ্যক হেলিকপ্টার ব্যবহার করা যাবে বলে জানিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রতিনিধি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগে সহায়তা প্রদান করতে বলা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে সব ধরনের সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে।

Scroll to Top