অপেক্ষার পালা শেষ , আজ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনের অপেক্ষা

সংগৃহীত ছবি

দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রস্তুত পুরোপরি। যানজটের শহর ঢাকায় টানা ১১ কিলোমিটার পথ বিরতিহীনভাবে গাড়ি চালানো যাবে—এটি আর কল্পনা নয়, বাস্তবে রূপ নিচ্ছে এ দেশে । আজ থেকে চালু হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা ঢাকা উড়াল মহাসড়ক। এটি দেশের প্রথম উড়াল মহাসড়ক।

বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত দীর্ঘ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। আপাতত বিমানবন্দরের কাওলা থেকে ফার্মগেট অংশের উড়াল মহাসড়কের দ্বার উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামীকালর (৩ সেপ্টেম্বর) ভোর ৬টা থেকে যানচলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে এই এক্সপ্রেসওয়ে। আগামী বছর বাকি অংশ উদ্বোধন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

এ মহাসড়কে সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলবে গাড়ি। ফলে দীর্ঘ অপেক্ষার এই প্রকল্প কিছুটা হলেও নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে পারবে বলে মনে করছেন যোগাযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রকল্পটি অন্যতম ধীরগতির প্রকল্প হিসেবে বারবার আলোচনায় এসেছে।
এটার প্রকল্প শুরু ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি।

কিন্তু জমি না পাওয়া, নকশায় জটিলতা, অর্থায়নের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় কাজ শুরু করা যায়নি। অবশেষে ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ চীনের দুই ব্যাংক থেকে ঋণ পায় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। অবশেষে প্রকল্প হাতে নেওয়ার ৯ বছর পর ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু হয়। রাজধানীর দুই প্রান্তকে উড়াল মহাসড়কের মাধ্যমে যুক্ত করতে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।

এটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি প্রকল্প (পিপিপি)। পরিকল্পনা অনুযায়ী, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাওলা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা নিশ্চিত করাই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এখানে মূল সড়কের দৈর্ঘ্য ১৯.৭৩ কিলোমিটার। সঙ্গে ওঠানামার ৩১টি পথ (র‌্যাম্প) মিলিয়ে পুরো পথের দৈর্ঘ্য ৪৬.৭৩ কিলোমিটার।

এই পথের সঙ্গে গাজীপুর হয়ে সাভারমুখী আরেকটি নির্মীয়মাণ উড়াল মহাসড়ক যুক্ত করবে সরকার।

দ্বিতীয়টির নাম ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এর দৈর্ঘ্য ২৪ কিলোমিটার। এই দুই এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হলে সাভার ইপিজেড থেকে আশুলিয়া-বাইপাল-আব্দুল্লাহপুর হয়ে বিমানবন্দর, কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী হয়ে কুতুবখালী পর্যন্ত এক রেখায় যুক্ত। এ পথেও মোট দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৪৪ কিলোমিটার। র‌্যামসহ পুরো পথের দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে প্রায় ৮২ কিলোমিটার।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশ আজ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাল রবিবার সকাল ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য এই পথ খুলে দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) সূত্র জানায়, আজ বিকেল সাড়ে ৩টায় প্রধানমন্ত্রী বিমানবন্দর অংশে একটা ফলক উন্মোচন করবেন। এরপর টোল দিয়ে কাওলা র‌্যাম্প দিয়ে তিনি এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবেন। নামবেন ফার্মগেটে এসে। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলানগরে পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠে আয়োজিত সমাবেশে যোগ দেবেন।

সেতু কর্তৃপক্ষ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এতে বিভিন্ন পর্যায়ের পাঁচ হাজার অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

জানতে চাইলে বিবিএর নির্বাহী পরিচালক ও সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হয়। ব্যস্ত সড়ক ও রেললাইনের ওপর দিয়ে কাজ করায় তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টা করতে পারিনি। তবে এখন কাজের অগ্রগতি ভালো। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাকি কাজ শেষ করতে পারব।’

মনজুর হোসেন বলেন, এক্সপ্রেসওয়ের সাড়ে ১১ কিলোমিটার মূল সড়ক। র‌্যাম্প আছে আরো ১১ কিলোমিটার। চার লেনের এমন একটি সড়ক ঢাকা শহরে যুক্ত হওয়ায় রাজধানীর বিদ্যমান সড়কের ওপর থেকে কিছুটা হলেও চাপ কমবে। এই পথে যানজটে ভোগা যাত্রীরা অন্তত একটা নিঃশ্বাস নেওয়ার তো সুযোগ পাবে।

উত্তর থেকে ফার্মগেটমুখী যানগুলো এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা, প্রগতি সরণি ও বিমানবন্দর সড়কের আর্মি গলফ ক্লাবের সামনের র‌্যাম্প ব্যবহার করবে। আর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নামার জন্য বনানী কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে, ফার্মগেট প্রান্তে ইন্দিরা রোডের পার্শ্বের র‌্যাম্প ব্যবহার করবে।

আর ফার্মগেট থেকে উত্তরামুখী যানবাহনগুলো বিজয় সরণি ওভারপাসের উত্তর ও দক্ষিণ লেন, বনানী রেলস্টেশনের সামনের র‌্যাম্প ব্যবহার করবে। তারা নামার জন্য মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে, বনানী কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর সামনে বিমানবন্দর সড়ক, কুড়িল বিশ্বরোড এবং বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনালের সামনের র‌্যাম্প ব্যবহার করবে।

সরেজমিনে এক্সপ্রেসওয়েতে দেখা যায়, কাওলা প্রান্তে ছয়টি টোল বুথ বসানো হয়েছে। সড়ক বিভাজনের ওপরে বসেছে বিদ্যুতের খুঁটি। তাতে বাতি বসানোর কাজ শেষ। রাতে বাতিগুলো জ্বালিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। সড়কে লেন নির্ধারণের জন্য বিভাজন রেখা দেওয়া হয়েছে। সড়ক চিহ্ন ও নির্দেশিকা বোর্ড বসানো হয়েছে। তবে ১৫টি র‌্যাম্পের মধ্যে দুটির কাজ এখনো চলছে।

জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, পুরো পথ চালু না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না। তবে আংশিক পথে সম্ভাবনার ইঙ্গিত তৈরি হচ্ছে। এখন শুধু দেখার বিষয় ফার্মগেট অতিরিক্ত গাড়ির চাপ কিভাবে সামলায়।

প্রকল্পের নির্মাণকাজের জন্য কাওলা থেকে বনানী, বনানী থেকে মগবাজার ও মগবাজার থেকে কুতুবখালী তিন ভাগে ভাগ করা হয়। আজ চালু হচ্ছে প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগের অর্ধেক। প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফাস্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কম্পানি লিমিটেড। সরকারের দিক থেকে ভূমি অধিগ্রহণসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হয়। সঙ্গে মোট খরচের একটি অংশ দেয় সরকার।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কালের কণ্ঠকে বলেছিলেন, ‘শুরু থেকেই প্রকল্পটি চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমি যখন মন্ত্রী হয়ে আসি তখন এই প্রকল্পের কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না। এখন একটা পর্যায়ে এসেছে।’

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পকে সহযোগিতা করতে থোক বরাদ্দের বাইরেও ‘সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রজেক্ট’ নামে আলাদা একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এই প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ করা ছিল মূল কাজ। প্রকল্পের প্রায় পুরো পথ তৈরি হয়েছে বিদ্যমান রেলপথের ওপর দিয়ে। তবুও ভূমি অধিগ্রহণ, ইউটিলিটি অপসারণ-প্রতিস্থাপন, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ, পরিবেশগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা কার্যক্রম এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ভবন ও অন্যান্য সুবিধাদি দিতে সাপোর্ট প্রকল্পে সরকারের খরচ হচ্ছে চার হাজার ৯১৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।