১৩ বছর পর চালু হবে সাড়ে ১১ কিলোমিটার পথ: সেতুমন্ত্রী

দেশের মানুষের কথা ভেবে টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় আছেন শেখ হাসিনা :ওবায়দুল কাদের
গুলশানে ইফতার সামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানে সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের - সংগৃহীত ছবি

দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়াল মহাসড়ক নির্মিত হচ্ছে। লক্ষ্য ওপর দিয়ে ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াত করা। তবে, সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলার এই প্রকল্প সহজে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। উল্টো এটি অপরিকল্পিত উন্নয়নের একটি উদাহরণ হয়ে গেল।

দেশের সবচেয়ে ধীরগতির অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলির মধ্যে একটি হল ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। ১৯ জানুয়ারী, ২০১১ তারিখে, চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে জমি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি, নকশায় জটিলতা এবং অর্থের অভাবের কারণে কাজ শেষ হয়নি। তবে অবশেষে আগামী ২ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের আংশিক কাজ শুরু করবে সরকার।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলছেন, ঢাকা অবশ্য কয়েক বছর ধরে প্রকল্পের একাংশ যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে । তার সাম্প্রতিক ঘোষণায় বলা হয়েছে যে আগামী ২ সেপ্টেম্বরে খুলে দেওয়া হবে কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশ। ১৩ বছর পর চালু হবে ১১.৫ কিলোমিটার রাস্তা । প্রকল্পের মূল সড়কের বাকি থাকবে আরো প্রায় ৯ কিলোমিটার।

এক্সপ্রেসওয়ে পার হলেই দেখা যায়, কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। কাওলা প্রান্তে ছয়টি টোল বুথ রয়েছে। বনানী র‌্যাম্পেও একটি টোল বুথ রয়েছে। উদ্বোধনের আগে বিভিন্ন স্থানে রং করছেন কর্মীরা। সড়ক বিভাজকের ওপর বসেছে বিদ্যুতের খুঁটি।

বাতি বসানোর কাজও শেষ। পরীক্ষা চালানোর জন্য রাতেও এসব বাতি জ্বালানো হচ্ছে। রাস্তার মার্কিংয়ের কাজও শেষ হয়েছে।

গত ১৮ জুন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে আলোচনা করেন এই প্রতিবেদক। তিনি একটি প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এটা আমি স্বীকার করি, এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎই ছিল না। আমি যখন আসি তখন শুধু ভিত্তিপ্রস্তর ছিল। প্রকল্পের টাকা বরাদ্দসহ কোনো কিছুরই নিশ্চয়তা ছিল না।’

ওবায়দুল কাদের বলেন, এটি অনেক চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প। শুরু যখন হয়ে গেছে তখন পথ থেকে সরে যাব, এটাও তো ঠিক না। সরে গেলে বাংলাদেশে প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপে (পিপিপি) প্রকল্প হয় না, এমন খারাপ ধারণা সৃষ্টি হতে পারত। সে জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি। এখন তো মোটামুটি একটা পর্যায়ে এসেছে।’

গতি ৬০, চলবে না ২-৩ চাকার যান:

এই উড়াল মহাসড়কে সেতু বিভাগ ৬০ কিমি/ঘন্টা গতির সীমা নির্ধারণ করেছে। দুই ও তিন চাকার যান চলাচলও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা চলাচল করতে পারছে না। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত যানজটের ক্ষেত্রে প্রকল্পের সুফল কতটা মিলবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, যেহেতু উড়াল পথ এবং যাত্রা হবে বিরতিহীন, তাই পথে যাত্রী নেওয়ার সুযোগ নেই। তার ওপর টোল দিতে হবে। ফলে বাসগুলো এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবে কি না তা এখনই বলা যায় না। তার তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি বেশি চলবে। তিনি বলেন, সড়কটি আংশিক চালু করায় এর সুবিধা এখনই পুরোপুরি বোঝা যাবে না।

হাদিউজ্জামান আরো বলেন, পথটি চালু হলে তা ফার্মগেট এলাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আংশিক চালু হওয়ায় ফার্মগেটে কী পরিমাণ গাড়ির চাপ পড়বে সেটার একটা সমীক্ষা করার দরকার ছিল। আর শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের ওপর নির্ভরশীল এক্সপ্রেসওয়ে সহজে লাভের মুখ দেখতে পারার কথা নয়।

শুরুতেই খুলছে না সব র‌্যাম্প:

কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সৈয়দাবাদ-যাত্রাবাড়ী হয়ে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে অবস্থিত কাওলার সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীকে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। পুরো রাস্তা নির্মাণের জন্য কাওলা থেকে বনানী, বনানী থেকে মগবাজার এবং মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশ এখন শুরু হয়েছে, এবং দ্বিতীয় অংশ অর্ধেক পেরিয়ে গেছে।

সরকারি বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে। এতে বিনিয়োগ করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফাস্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড। সরকার জমি অধিগ্রহণসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করে। মোট খরচের একটি অংশ দেয় সরকার।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। তবে খুলতে যাওয়া অংশের কাজ হয়েছে ৯৮ শতাংশ। উদ্বোধন অংশে র‌্যাম্প রয়েছে ১৫টি। এর মধ্যে বিমানবন্দর এলাকায় দুটি, কুড়িলে তিন, বনানীতে চার, মহাখালীতে তিন, বিজয় সরণিতে দুই ও ফার্মগেট এলাকায় একটি। তবে শুরুতে সব র‌্যাম্পে চলাচলের সুযোগ থাকছে না। কোন কোন র‌্যাম্প শুরুতে খুলবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

যদিও প্রকল্পের নির্মাণকাজ হচ্ছে তিন অংশে। এর মধ্যে প্রথম ধাপের দৈর্ঘ্য ৭.৪৫ কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাপের দৈর্ঘ্য ৫.৮৫ কিলোমিটার এবং তৃতীয় ধাপের দৈর্ঘ্য ৬.৪৩ কিলোমিটার। মূল পথ ১৯.৭৩ কিলোমিটার। সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠানামার জন্য পথ থাকবে ৩১টি। এই ওঠানামার পথসহ (র‌্যাম্প) সর্বমোট দৈর্ঘ্য দাঁড়াচ্ছে ৪৬.৭৩ কিলোমিটার।

এক প্রশ্নের জবাবে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, মূল সড়কের অবকাঠামোর জটিল ও বড় কাজগুলো আগেই শেষ হয়েছে। এখন শেষ মুহূর্তের খুঁটিনাটি কাজগুলো চলছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের হাতে এখনো এক সপ্তাহের বেশি সময় আছে। উদ্বোধন এলাকায় সামান্য যে কাজ বাকি সেগুলো এর মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।’

জমি অধিগ্রহণে বেড়েছে সময়:

হাতিরঝিল, খিলগাঁও, কমলাপুর এই তিনটি এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অবস্থান কঠিন। হাতিরঝিলেও বিতর্কের জেরে সরানো হচ্ছে র‌্যাম্প। খিলগাঁওয়ে রেললাইনের পাশের জায়গাটিকে রেলপথ মন্ত্রণালয় আপত্তিকর বলে গণ্য করেছে। সেই সমস্যাও মিটে গেল।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইনের সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও দুটি নতুন রেললাইন যুক্ত হতে পারে। পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের অংশ হিসেবে কমলাপুরে রেললাইনের নিচে একটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব সমস্যার কারণে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ আরও বিলম্বিত হয়। ফার্মগেট পর্যন্ত খোলা হচ্ছে, কুতুবখালি ২০২৩ সালের মধ্যে খোলার সময়সূচির সাথে।

রেল আরো বলেছে, ভবিষ্যতে তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইনের পাশে আরো দুটি নতুন রেললাইন তৈরি হতে পারে। আর কমলাপুরে জটিলতা মীমাংসা করতে গিয়ে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের রেললাইনের নিচ দিয়ে আন্ডারপাস তৈরি করা হচ্ছে। এসব জটিলতার কারণে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ আরো পিছিয়ে যায়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের মধ্যে যেখানে কুতুবখালী পর্যন্ত উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল, সেখানে খুলছে ফার্মগেট পর্যন্ত।

নকশার জটিলতা নিয়ে জানতে চাইলে সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ওটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আপাতত তেজগাঁও আমাদের টার্গেট।’

প্রকল্পের বাকি অংশের ভবিষ্যৎ কী জানতে চাইলে সড়কমন্ত্রী আরো বলেন, ‘একটি-দুটি প্রকল্পে সমস্যা হতেই পারে। আমাদের দেশে তো এগুলো সব প্রথম।’

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) সংশ্লিষ্ট এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করে জানান, প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। তবে এই সময়ের মধ্যে বাকি কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। তিনি জানান, যতটুক কাজ হয়েছে আরো প্রায় ততটুক বাকি আছে। ফলে প্রকল্পের সময় আরো বাড়বে।

সংগৃহীত ছবি

পুরো এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাউন্ডিংয়ের আওতায় চুক্তি অনুযায়ী দুই হাজার ৪১৩ কোটি টাকা দেবে সরকার। বাকি টাকা ঠিকাদার বিনিয়োগ করবে। ২০২০ সালের শুরু থেকে ধরে পরের ২১ বছর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল আদায়ের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের টাকা তুলে নেবে।

যানবাহনগুলোকে চার শ্রেণিতে ভাগ করে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল, ১৬ সিটের কম মাইক্রোবাস ও তিন টনের কম হালকা ট্রাকের ক্ষেত্রে টোল দিতে হবে ৮০ টাকা। ১৬ বা তার বেশি আসনের সব ধরনের বাসের টোল ১৬০ টাকা। ছয় চাকা পর্যন্ত মাঝারি ট্রাকের টোল ৩২০ টাকা। ছয় চাকার বেশি ট্রাকের টোল ৪০০ টাকা।

পথের দূরত্ব বিবেচনায় টোল প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান তার লাভসহ টাকা তুলতে বাণিজ্যিকভাবে টোল নির্ধারণ করবে। তবে ২০১৩ সালে চালু হলে টোল এত বেশি হতো না।

শামছুল হক বলেন, এটা শহরের ভেতরের সড়ক। তাই ২৪ ঘণ্টা এই পথে গাড়ি চলবে না। নিচের সড়ক ফাঁকা থাকলে কেউ ওপরে উঠবে না। আবার বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত সড়কটি ভালো। ফার্মগেট পর্যন্ত চালু না হয়ে পুরো পথ চালু হলে চিত্র ভিন্ন হতে পারে। তবে এখন দেখার বিষয় এই উড়াল মহাসড়ক গাড়ি আকৃষ্ট করতে পারে কি না!