শাহআলম শুভ
সোহেলের মা কিডনি সমস্যায় ভুগছেন দীর্ঘদিন ধরে। প্রতি সপ্তাহে দু’বার ডায়ালাইসিস করতে প্রায় সাত থেকে আট হাজার টাকা লাগে। প্রতিমাসে আরও অনেক টাকা খরচ হয় চিকিৎসার জন্য। সোহেলের বাবা সদ্য সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। এই অবস্থায় মা‘র চিকিৎসার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সোহেলকে। উপায়ন্ত না পেয়ে তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। তাঁর বন্ধু তাকে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন। হাসপাতালটিতে কম মূল্যে কিডনি জনিত রোগের চিকিৎসা দেয় বলে সোহেলকে জানায় তাঁর বন্ধু। সোহেল প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি এত কম খরচে কিডনি ডায়ালাইসিস করা হয়। কিন্তু হাসপাতালটিতে গিয়ে সোহেলের ধারণা পাল্টে যায়। অল্প খরচে মা‘র ডায়ালাইসিস করতে পেরে সোহেল এখন থেকে এখানেই নিয়মিত মা’র চিকিৎসা করাচ্ছেন।
গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকতেই দেখা যায়, রোগীরা চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। রোগীরা আসলেই তাঁদেরকে প্রথমে ডাক্তার দেখানো হচ্ছে। এরপর রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালটির ৪র্থ ও ৫ম তলায় কিডনি ডায়ালাইসিস করানো হচ্ছে। ৪র্থ ও ৫ম তলায় মোট ১০০ টি বেড রয়েছে। যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৫০০শ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে।
গরীব অসহায় রোগীরা নামে মাত্র দিয়েই উন্নতমাণের চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি মাত্র ৫৩৪ টাকায় কিডনি ডায়ালাইসিস করাচ্ছে হাসপাতালটি। সকাল ও বিকাল দুই শিফটে রোগীদের ডায়ালাইসিস করানো হচ্ছে।
আলী হোসেন বরগুনা থেকে এসেছেন কিডনি ডায়ালাইসিস করানোর জন্য। মাসে চার দিন ডায়ালাইসিস করাতে হয় তাঁর। এর আগে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল হাপাতালে ডায়ালাইসিস করাতেন। সেখানে প্রতি ডায়ালাইসিসে ৩থেকে ৪ হাজার টাকা লাগত। কিন্তু এখানে ডায়ালাইসিস মাত্র ১১০০ টাকা করতে পেরে তার চোখে মুখে স্বস্তির ছাপ দেখা য়ায়।
আলী হোসেন বলেন, ‘এর আগে এখানে দুইবার ডায়ালাইসিস করেছি ২২০০ টাকা দিয়ে আজকে কোন টাকা লাগে নাই, ডাক্তার বলছে আপনার আজকে আর টাকা লাগবে না। জায়গা জমি যা ছিল চিকিৎসার জন্য সব শেষ করে ফেলছি। এই হাসপাতাল না থাকলে চিকিৎসা করতে পারতাম না।
পারুল গাজীপুর থেকে তাঁর মেয়েকে নিয়ে এসেছেন চিকিৎসা করানোর জন্য। পারুল জানায়, এখানে আসার আগে গ্রিন রোডের একটি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার মেয়েকে চিকিৎসার জন্য। সেখানে দুইদিন তার মেয়েকে আইসিওতে রেখে ৭৫ হাজার টাকা নিয়েছেন হাসপাতালটি। মেয়ের পাঁচ বছর বয়সে স্বামী মারা যায় বলে জানায় পারুল। কথাগুলো বলার সময় পারুলের চোখের পানি ধরে রাখতে ধরে রাখতে পারছিলেন না। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে গার্মেন্টস চাকরি করে যে টাকা জমিয়ে ছিলাম তা সব শেষ করেছি মেয়ের চিকিৎসার জন্য। এখানে চিকিৎসা করাতে কিরকম খরচ লাগতেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন অন্য হাসপাতালের চেয়ে কম খরচ নিচ্ছে। তবে পারুল জানায় শুনছি এখানে নাকি বিনা খরচে চিকিৎসা করায়। সেই কথা শুনে আসছিলাম।
মঞ্জুর আলম আরেক রোগী এসেছেন গাজীপুরের কালিগঞ্জ থেকে। তিনি বলেন, এখানকার সেবার মান খুবই ভাল। অল্প টাকায় আমরা উন্নত সেবা পাচ্ছি।
হাসপাতালটির সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মো. ফরহাদ জানান, প্রতিদিন দুই শিফটে প্রায় ২০০ রোগীকে ডায়ালাইসিস করানো হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন রোগীর সংখ্যা ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশজন। ডায়ালাইসিস এর খরচ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের এখানে রোগীদেরকে তিনটি ভাগে ভাগ করি। নিম্ন, মধ্যবিত্ত ও সচ্ছল এই তিন ক্যাটাগরিতে ফেলে তাঁদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকি। অসহায় ও নিম্নবিত্তদের জন্য ৫৩৪ টাকা থেকে শুরু করে ১১০০টাকা, মধ্যবিত্তদের ১৫০০ টাকা এবং সচ্ছলদের জন্য প্রতি ডায়ালাইসিসের জন্য ৩০০০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। আবার রোগীর আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ থাকলে আমরা তাঁকে ফ্রি ডায়ালাইসিসও করিয়ে থাকি।
তিনি আরও জানান, পাশাপাশি যাদের নিবিড় পরিচর্যা দরকার তাদের জন্য কয়েকটি পৃথক শয্যা আছে। হেপাটাইটিস বি ও সি আক্রান্ত রোগীদের জন্যও পৃথক শয্যা আছে। মূলত সংক্রমণ এড়াতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।সময়ও খরচ সম্পর্কে ফরহাদ বলেন, একবার ডায়ালাইসিস করতে সময় লাগে চার ঘণ্টা। একটি যন্ত্রে দিনে ৩ জন রোগীকে ডায়ালাইসিস করা হচ্ছে।
প্রতিদিন যে পরিমাণে রোগী তাঁর সংকুলান কীভাবে করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের এখানে সেবা নেওয়ার জন্য ঢাকা ও ঢাকার বাহরে থেকেও প্রতিদিন অনেক রোগী আসতেছে। আমরা আমাদের হেড অফিস সাভারে কিছু রোগীকে স্থানান্তর করার কথা ভাবছি। এছাড়া সারা বাংলাদেশে এই সেবা পৌছে দেওয়ার জন্য ঢাকার বাইরে বরিশাল,চট্টগ্রামও সিলেট তিনটি জেলায় গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যেগ নিয়েছি। ইতিমধ্যে বরিশালে আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।
হাসপাতালের চার তলায় অভ্যর্থনায় দায়িত্ব কর্মকর্তাগুলো দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন। এত লোক সেবা দিচ্ছেন এতে আপনাদের অনুভূতি কী জানতে চাইলে একজন বলেন, এখানে যারা আসেন তাঁদেরকে যথাসাধ্য সেবা চেষ্টা করছি। আমরা আমাদের মা-বাবার মত তাঁদেরকে সহযোগিতা করছি।
গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘কিডনি রোগীদের চিকিৎসা আছে। কিন্তু মানুষ অর্থাভাবে চিকিৎসা পাচ্ছে না। মানুষকে কম মূল্যে সেবা দেওয়ার জন্য এই উদ্যোগ। এটি এখন দেশের সবচেয়ে বড় ডায়ালাইসিস কেন্দ্র।’
তিনি আরও বলেন, সরকারের লক্ষ্য যেহেতু স্বাস্থ সেবা গণমানুষের কাছে পৌছে দেওয়া। আমরা সেই কাজটিই করছি। সরকারের সহায়তা পেলে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে।
গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টার
বাড়ি#১৪/২, সড়ক#৬, ধানমন্ডি, ঢাকা- ১২০৫
ফোন: ০২- ৯৬৭০০৭১-৭৫, ০১৭০৯-৬৬৩১১৪
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৬ ঘণ্টা, ২৫ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ