দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ স্থাপনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রাশিয়া যে ঋণ দিয়েছে, তার সুদ-আসল নিজস্ব মুদ্রা রুবলে পেতে চায় দেশটি। এসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সরকারকে পাঠিয়েছে রাশিয়া। তাদের এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
রাশিয়াকে রুবলে ঋণ পরিশোধের আগে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশকে দুটি চুক্তি সংশোধন করতে হবে। এ বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে শিগগির সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
চুক্তির মধ্যে শর্ত রয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে রাশিয়াকে ডলারে সুদ-আসল পরিশোধ করা হবে। এটা পরিবর্তন করে নতুন চুক্তি করে রাশিয়াকে ডলার অথবা অন্য কোনো কারেন্সিতে সুদ-আসল পরিশোধ করা যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে দুটি চুক্তি আছে রাশিয়ার ব্যাংক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ফরেন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্সের (ভিইবি)। এই চুক্তিও বাতিল করতে হবে। রাশিয়ার যে ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক এই প্রকল্পের অর্থ লেনদেন করে, সেই রুশ ব্যাংকটি তাদের সঙ্গে আপাতত লেনদেন থেকে বিরত থাকতে বলেছে বাংলাদেশকে। কারণ রাশিয়ার ওই ব্যাংক বৈশ্বিক অর্থ লেনদেনের মাধ্যম সুইফটের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়েছে। সুতরাং রাশিয়া যেভাবে চায়- চাইলেই সেভাবে দিতে পারবে না বাংলাদেশ। পাশাপাশি রাশিয়ার ঋণের সুদ-আসল রুবলে পরিশোধের ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা রয়েছে। কয়েক দফা মুদ্রা পরিবর্তনের ফলে যে বাড়তি ব্যয় দাঁড়াবে, তার দায় কে নেবে, তা-ও ঠিক করতে হবে।
মূলত ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর পর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা ও বৈশ্বিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফট থেকে রুশ ব্যাংকগুলোকে বের করে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া এই প্রস্তাব দিয়েছে।
সূত্র বলছে, রাশিয়ার পাঠানো প্রস্তাব নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু করেছে ইআরডি। তবে তারা এ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারেনি। কবে নাগাদ এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে নেই। তাঁরা বলছেন, চীনের মাধ্যমে এই লেনদেন করতে পারে বাংলাদেশ। তবে রুবলে ঋণের সুদ-আসল পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যয় ও ঝুঁকি বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে নাম না প্রকাশ করার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, রূপপুরের ঋণের সুদ-আসল নিজেদের মুদ্রা রুবলে অথবা চীনের মুদ্রা ইউয়ানে পেতে চায় রাশিয়া। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয়। ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুমোদনের সময় কিছু চুক্তি সই করা হয়।
চুক্তিতে বলা আছে, ডলারে পরিশোধ করা হবে। প্রথমে এটা সংশোধন করতে হবে। এ ছাড়া রুবল বা ইউয়ানের শক্ত সোর্স আমাদের নেই, তবে ডলারে আছে। সুতরাং টাকার বাইরে যাই কেনা হবে তা ডলার দিয়েই কিনতে হবে। ভিইবি ব্যাংককে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তা হলে টাকা পরিশোধের নিরাপদ রুট কোথায়? রুবলে পরিশোধ করতে গেলে প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়বে। বাড়তি ব্যয় কে পরিশোধ করবে? সে বিষয়গুলো পরিষ্কার করতে হবে। ’
রাশিয়ার ঋণের শর্ত অনুযায়ী, ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে শুধু সুদ এবং এর পর থেকে সুদ ও আসল কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। রূপপুরের ঋণ পরিশোধ নিয়ে রাশিয়া বাংলাদেশকে দুটি চিঠি দিয়েছে। প্রথম চিঠি দেওয়া হয় গত ২৩ জুন। এতে দুই দেশের মধ্যে সই করা আন্ত সরকার ঋণচুক্তির (আইজিসিএ) ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এরপর গত ১০ আগস্ট আরেকটি চিঠি দেয় রাশিয়া। এতে মার্কিন ডলার ও ইউরোতে লেনদেন নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে রুবলে লেনদেনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যে চুক্তি আছে তাতেই সুদ-আসল পরিশোধ করা যৌক্তিক হবে। রুবলের রেট সব সময় ওঠানামা করে। সকালে এক রেট থাকে বিকেলে আরেক রেট। ৩০ শতাংশ পর্যন্ত দিনে ওঠানামা করার রেকর্ড আছে। সুতরাং রুবলে পরিশোধ করা ঝুঁকি অনেক।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমকে বলেন, যেভাবে চুক্তি আছে, সেভাবে রাশিয়াকে সুদ ও ঋণ পরিশোধ করা ঠিক হবে। রুবলে পরিশোধ করা উচিত হবে না। রুবলের রেট সব সময় অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। সকালে এক তো বিকেলে আরেক থাকে। তবে ১০ কোটি ডলার যেকোনোভাবে পরিশোধ করা যায়, এতে লাভ-ক্ষতি খুব একটা বেশি নয়। তবে বড় ঋণ পরিশোধ কিভাবে করতে হবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে।’