রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন স্ত্রীর টেলিফোনে তাৎক্ষণিকভাবে এক টিটিইকে বরখাস্তের বিষয়ে বলেছেন, ‘নতুন যাকে আমি স্ত্রী হিসেবে নিলাম, আমাকে বুঝে উঠতে তারও সময় লাগবে। ভুল-ভ্রান্তি হলে মানুষ তো সেভাবেই দেখবে। এখানে যদি দেখা যায়, আমার স্ত্রী কোনো দোষ করে থাকে, ইয়ে করে থাকে, এটা কিন্তু আমার নলেজে ছিল না।’
আজ রোববার (৮ মে) দুপুরে রেল ভবনে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
রেলমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেহেতু এটা ডিউ প্রসেসে (নিয়ম মেনে) করা হয়নি, তাই টিটিই’র ওই সাসপেনশন অর্ডার (বরখাস্তের আদেশ) আমরা উইথড্র (প্রত্যাহার) করেছি। যে ডিসিও (ডিভিশনাল কমার্শিয়াল অফিসার) এ ধরনের অর্ডার দিয়েছেন তাকেও শোকজ করেছি। তিনি এই অর্ডার কীভাবে দিলেন? একজন যাত্রী ঢাকা আসছেন, এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি লিখিত অভিযোগটা কীভাবে পেলেন? বোঝা গেলো, টেলিফোনে অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি ব্যবস্থা নিয়েছেন। এটার ব্যাখ্যা আমরা চেয়েছি।’
রেলমন্ত্রী দাবি করেন, টিটিই শফিকুল ইসলামের বরখাস্তের আদেশের বিষয়ে কিছুই জানতেন না তিনি। মন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমি শুনেছি, বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করায় আমার স্ত্রীর বোনের ছেলেদের জরিমানা করা হয়েছে। এ বিষয়টি আমার স্ত্রী টেলিফোনে রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানায়। তখন তাৎক্ষণিকভাবে টিটিই শফিকুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়। এর আগে আমার স্ত্রীর আত্মীয়দের জরিমানা বা টিটিইর বরখাস্তের বিষয়ে কিছুই জানতাম না।’
তিনি বলেন, ‘শোনেন, এ ঘটনা আপনারা যেভাবে শুনেছেন, আমিও সেভাবে শুনেছি। আমি আগাম কিছু শুনিনি। আমার স্ত্রীর খালাতো বোন বা মামাতো বোন দাবি করে যে কথাগুলো বলেছে, আপনারা যেভাবে শুনেছেন, আমিও মন্ত্রী হিসেবে একইভাবে শুনেছি। কিন্তু আমি আগে থেকেই জানতাম বা অমুক আত্মীয়-এটা জানা ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘আমি এ ঘটনার পরে স্ত্রীকে টেলিফোন করেছি। ওয়াইফ যেটা বলেছে, তিনি রেল কর্মকর্তাদের কাছে টেলিফোন করেছে। বলেছে, এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটেছে, বিষয়টা আপনারা দেখেন।’
নিজের ৩৭ জন ভাগনে-ভাগনি উল্লেখ করে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘আমার ভাগনে-ভাগনিদেরও ছেলেমেয়ে আছে, পুতি পর্যন্ত আছে। এখন কে কোথায় আত্মীয় পরিচয় দিয়েছে, সেটা তো আমরা পক্ষে জানা সম্ভব নয়। যাত্রী হয়ে বিনা টিকিটে ভ্রমণ, এটা তো নতুন কিছু নয়। এজন্য টিটিইদের কাছে আমরা টাকা আদায়ের জন্য রিসিট দেই।’
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বিনা টিকিটে যারা রেলে ভ্রমণ করেছিলেন, তাদের একজন ইমরুল কায়েস। তিনি হাতে লেখা চিঠিতে ওই টিটিইর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত টাকা দাবির এবং হুমকি দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। চিঠিটিতে ৫ মে স্বাক্ষর করা হয়েছে। অর্থাৎ ইমরুল কায়েস ট্রেনে চড়ে ঢাকায় পৌঁছেই অভিযোগটি দায়ের করেছেন। অভিযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই টিটিই শফিকুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
বিনা টিকিটের প্রভাবশালীদের স্বজন বা আত্মীয় যাত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পর একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি নেতিবাচক বার্তা যাবে কি না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘মেসেজটা যেভাবে গেছে, সেটা সঠিক হয়নি। ডিসিপ্লিন আনার ক্ষেত্রে একজন টিটিইর এটাই দায়িত্ব যে, বিনা টিকিটে কেউ ভ্রমণ করছে কি না। রেলে যাত্রীদের সহযোগিতা করা, তাকে সাহায্য করা, সঠিক সেবা দেওয়া। রেলের স্বার্থটাও তিনি দেখবেন আর মানুষের সঙ্গে এমন ব্যবহার করবেন না, যাতে রেলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।’
টিটিই শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা হলে পুরস্কৃত করা হতে পারে জানিয়ে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘এ ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে টিটিই নির্দোষ হলে প্রমোশনও পেতে পারেন, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন, সেটা তারা বিবেচনা করে দেখবেন। তবে এখন যে ঘটনা ঘটেছে তাতে আমরা বিব্রত। আমরা রেলের টিটিই, বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী, যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন, তাদের বিরুদ্ধে তো এ ধরনের অভিযোগ পাই। আমরা ব্যবস্থাও গ্রহণ করি।’
এ ঘটনায় দুর্নীতির বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) রেলমন্ত্রীকে ‘সাময়িকভাবে পদত্যাগ’ করার আহ্বান জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী বলেন, টিআইবি এখানে কোত্থেকে আসলো? টিআইবি কে? তাদের তো আরও অপেক্ষা করা উচিত ছিল। এখানে মন্ত্রীর সরাসরি কোনো নলেজ বা সম্পৃক্ততা আছে কি না। কারণ এটা করা হয়েছে একেবারে ডিসিও লেভেলে।…এটা ওই লেভেলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
কি ঘটেছিল সেদিন
রেলওয়ে জানায়, গত ৪ মে রাতে আন্তঃনগর ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন স্টেশন থেকে তিনজন যাত্রী বিনা টিকিটে এসি কেবিনে ভ্রমণ করছিলেন। ট্রেনটি খুলনা থেকে ঈশ্বরদী হয়ে ঢাকা আসছিল। ওই তিনজন যাত্রী রেলের একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে ভ্রমণ করছিলেন। কিন্তু তাদের কোনো টিকিট ছিল না। তারা নিজেদের ‘রেলমন্ত্রীর আত্মীয়’ পরিচয় দিয়ে শোভন টিকিট কেটে দিয়ে এসি কেবিনে ভ্রমণ করতে দেওয়ার অনুরোধ করেন। ওই তিনজন ব্যক্তির একজন রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর মামাতো বোনের ছেলে। কিন্তু বিনা টিকিটে ভ্রমণের জন্য ওই তিন যাত্রীকে জরিমানা করেন কর্তব্যরত টিটিই শফিকুল। পরদিন বৃহস্পতিবার তাকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হয়।