দেশের ইতিহাসে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ দামে

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে বর্তমান খুচরা বাজারে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে। গত রবিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম সর্বোচ্চ ১৫৩ টাকা নির্ধারণ করেছে। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালের মাঝামাঝিতে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম সর্বোচ্চ ১৩৫ টাকায় উঠেছিল। গত এক দশকে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১’শ থেকে ১১৫ টাকার মধ্যে ওঠানামা করলেও গত এক বছর ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দর লাগামহীন। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পামঅয়েলের দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে।

সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এই সময়ে খুচরা বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১’শ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে। ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ৪৬০ থেকে ৫১০ টাকার মধ্যে। এক লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৮৪ থেকে ৮৬ টাকায়। আর প্রতি লিটার সুপার পাম অয়েলের দাম ছিল ৭৩ থেকে ৭৬ টাকা। আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নতুন করে ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম সর্বোচ্চ ৭২৮ টাকা, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম ১২৯ টাকা ও সুপার পাম অয়েলের দাম ১১৬ টাকা নির্ধারণ করেছে।

টিসিবির হিসেবেই গত এক বছরে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলে ৩৮ দশমিক ১০ শতাংশ, ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিনে ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ, এক লিটারের খোলা সয়াবিন তেলে ৫১ দশমিক ৭৬ শতাংশ ও সুপার পাম অয়েলে ৬৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ দাম বেড়েছে।

গত বছর এপ্রিল থেকে জুন সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭’শ ডলারের আশেপাশে। আর এ বছর এপ্রিলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২’শ ডলারে। আর বর্তমানে প্রতি টন সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩৭০ ডলারে। যদিও এক মাস আগে তা ১ হাজার ৪৪০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আর প্রতি টন পামঅয়েল বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১৮০ ডলারে। পামঅয়েলের দামও এক মাস আগে ১হাজার ২৩০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন, পামঅয়েলের দাম বাড়তি কেন?

বিশ্লেষকদের হিসেবে, করোনার মধ্যেও বিশ্বে সয়াবিন, পামঅয়েলের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু ডলারের বিপরীতে উৎপাদক দেশগুলোর মুদ্রা শক্তিশালী হওয়ায় তেলের দাম বেড়েছে। এছাড়া উৎপাদক দেশগুলো রপ্তানি শুল্ক বাড়িয়েছে। তবে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার আরেকটি কারণ হলো, এই তেলের উপজাত পণ্য সয়ামিলের চাহিদা কমে গেছে। ফলে দাম বেড়েছে সয়াবিন তেলের।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী যেখানে ৫ কোটি ৮০ লাখ টন সয়াবিন তেল উৎপাদিত হয়, সেখানে ২০২০ সালে উৎপাদিত হয়েছে ৬ কোটি ১০ লাখ টন। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সয়াবিন তেল উৎপাদিত হয় চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায়। তবে চীনে উৎপাদিত প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টন সয়াবিন তার নিজস্ব চাহিদা মেটাতেই চলে যায়। আর যুক্তরাষ্ট্রে ৮০ লাখ টন সয়াবিন উৎপাদন করলেও দেশটি তার চাহিদা মেটাতে আরও ২০ লাখ টন সয়াবিন আমদানি করে থাকে। মূলত: ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাই সয়াবিন রপ্তানি করে থাকে। প্রতি বছর আর্জেন্টিনা প্রায় ৫৯ লাখ টন সয়াবিন রপ্তানি করে।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশী সয়াবিন তেল আমদানি করে ভারত। এরপর আলজেরিয়া। আর বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত সরিষা, সূর্যমুখীসহ অন্যান্য তেলবীজ থেকে সোয়া দুই লাখ টন তেল পাওয়া যায়। বাকিটা আমদানি করতে হয়। মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা থেকে এই তেল আমদানি করা হয়।

করোনা মহামারির কারণে শ্রমিক সংকটে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় গত জুন-জুলাই মৌসুমে পামঅয়েল উৎপাদন আশানুরূপ হয়নি। সামনে ফেব্রুয়ারিতে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনায় মৌসুম শুরু হবে। তাই এর আগে সয়াবিন ও পামঅয়েলের দাম কমার সম্ভাবনা দেখছি না।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত দর অনুযায়ী খুচরা বাজারে সুপার পামঅয়েল বিক্রি হচ্ছে না বলে ভোক্তারা অভিযোগ করেছে। তারা জানান, সরকার প্রতি লিটার সুপার পামঅয়েল ১১৬ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে তা ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।