কুচকুচে কালো, অর্ধতরল পদার্থ যা অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম থেকে পাওয়া যায় বিটুমিন। তবে বিটুমিন প্রাকৃতিক ভাবেও পাওয়া যায়। সড়ক নির্মাণ, রানওয়ে ইত্যাদি নির্মাণকার্যে এটি ব্যবহৃত হয়। বিটুমিনে অনেকটা আমদানিনির্ভর বাংলাদেশ। এই সুযোগে নিম্নমানের ভেজাল বিদেশি বিটুমিন দেশে ঢোকাচ্ছেন আমদানিকারকরা।
বিষয়টি নিয়ে কোনো তদারকি নেই। এতে প্রতিনিয়ত দেশে আসছে ভেজাল এসব বিটুমিন। আর সেই বিটুমিন দিয়েই দেশের হাজার হাজার কিলোমিটার সড়ক তৈরি হচ্ছে। এতে সরকার যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমন জনগণ পাচ্ছে না ভালোমানের টেকসই পাকা সড়ক।
জানা যায়, দেশে চাহিদার বিটুমিনের মোট চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ পূরণ করে সরকারি উৎপাদন প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। বাকি ৮০ শতাংশ বিটুমিনের চাহিদা মেটায় আমদানি করা বিটুমিন। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা হলো, বিটুমিন আমদানির পুরো প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আমদানি করা বিটুমিনে বিএসটিআই অনুমোদন নেই। পাশাপাশি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও বুয়েটের অনুমোদন ছাড়াই বিটুমিন আসছে দেশে।
সরেজমিনে দেখা যায়, আমদানি করা বিটুমিনগুলোকে, অবৈজ্ঞানিক উপায়ে রাখা হচ্ছে, মাসের পর মাস। যার ফলে গুণগত মান হারাচ্ছে।
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেনকোলজি (আইইউটি) সহযোগী অধ্যাপক ও বিটুমিন বিশেষজ্ঞ ড. নাজমুস সাবিক বলছেন, উৎপাদন থেকে আমদানি পর্যন্ত, অসাধু ব্যবসায়ীরা নানাভাবে আমদানি করা বিটুমিনের গুণগতমান নষ্ট করে। মুনাফার কৌশলে, বিক্রি হচ্ছে হাতে হাতে। আর প্রতিবারই মিশছে ভেজাল। আর অনেকক্ষেত্রে আমদানি করা বিটুমিনের উৎসও অজানা থাকে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিএসটিআই এর অনুমোদনহীন, কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে আমদানি হয়ে আসা এসব নিম্নমানের বিটুমিনগুলো আবার রাস্তায় ব্যবহার হচ্ছে। যার ফলে, বাংলাদেশের ৬০-৭০ ভাগ রাস্তা, নির্মাণের ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই বাস্তবতায়, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিম্নমানের আমদানি নির্ভর বিটুমিন ব্যবহারে রাষ্ট্রের ত্রিমুখী ক্ষতি হচ্ছে। এক. বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়। দুই. টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে না। আর তিন. কিছু অসাধু ঠিকাদার আর অসৎ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না। তাদের পরামর্শ, টেকসই সড়ক উন্নয়ন করতে হলে, দেশীয় ভালোমানের বিটুমিন ব্যবহারের পাশাপাশি নির্মাণকাজে তদাকরি বাড়াতে হবে।
অনুসন্ধানে আরো দেখা দেখা যায়, বিএসটিআই, বুয়েট কিংবা ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের গুণগত মান যাচাইয়ের সুযোগ কম থাকায় বিদেশ থেকে বিটুমিন আমদানিকারকরা কম দামের নিম্নমানের কিংবা ভেজাল ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন আমদানি করছেন এবং সেইসব বিটুমিন এখন দেশের বিভিন্ন সড়কে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের সড়কগুলো টেকসই হচ্ছে না। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ৮০-১০০ গ্রেডের পরিবর্তে ৬০-৭০ গ্রেডের গাঢ় বিটুমিন ব্যবহারের কথা বলা আছে। এদিকে বিএসটিআই কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক পণ্যের মান ধরলে গ্রেড অনুযায়ী ৫০ থেকে ৭০ পর্যন্ত খুবই উন্নত মানের বিটুমিন।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলীরা জানান, দেশে দুই ধরনের বিটুমিন বাজারজাত হয়। একটি ৬০-৭০ গ্রেডের, যা অধিকতর গাঢ়। এই শ্রেণির বিটুমিন রাস্তার পিচঢালাইয়ের কাজে ব্যবহৃত হলে সড়ক উন্নত ও টেকসই হয়ে থাকে। আর ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন কিছুটা তরল। তরল বিটুমিন দিয়ে পিচঢালাই হলে রাস্তা টেকসই হয় না। প্রকৌশলীরা আরও জানান, ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন গুণগত মানে তরল বা পাতলা হওয়ার কারণে গ্রীষ্মকালে সড়কগুলো গলে ঢিবির মতো উঁচু-নিচু বা ঢেউয়ের আকৃতি ধারণ করে। এতে সড়কে সৃষ্টি হয় অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত। আবার বর্ষায় বৃষ্টির সময় ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় এবং সড়কে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়। খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক
প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান মনির বলেন, দেশের সড়কে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা উত্তম। এই গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার হলে সড়ক খুবই টেকসই থাকে। ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন পাতলা হওয়ায় পিচঢালাইয়ের কাজ হলে গ্রীষ্মকালে রাস্তা গলে যায়। আমাদের আবহাওয়ার জন্য ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিনই উপযোগী, এটি ব্যবহারে সড়ক টেকসই হয় বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্র জানায়, দেশে বছরে প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টন বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারি ৭০ হাজার টন উৎপাদন করে। বাকি বিটুমিন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেসরকারিভাবে আমদানি করা বিটুমিন ভেজাল এবং গুণগত মান যাচাইয়ের খুব বেশি সুযোগ না থাকায় নিম্নমানের বিটুমিন দিয়ে দেশের সড়কে এসব কাজ হচ্ছে।
বিএসটিআইর একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশের বাজারে আমদানি করা বিটুমিনের নামে ভেজাল এবং মানহীন বিটুমিনে ছেয়ে গেছে। ওইসব ভেজাল এবং নকল বিটুমিনে সড়ক উন্নয়নের কাজ হওয়ায় সড়ক টেক সই হচ্ছে না। কম দামের ভেজাল বিটুমিনে সড়কের কাজ হওয়ায় রাস্তা দ্রুত ভেঙে যাওয়ার কারণেই সাধারণ মানুষের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। সড়ক উন্নয়নের কাজ করার কয়েক মাসের মধ্যেই ওইসব সড়ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।