নূর হোসেনের যত অবৈধ সম্পদ

নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূর হোসেনের উত্থান অনেকটা নাটকীয়ভাবে। সামান্য ট্রাক হেলপার থেকে কয়েক বছরেই তিনি বনে যান সাম্রাজ্যের রাজা। কোটি কোটি টাকা, বিলাসবহুল বাড়ি গাড়ির মালিক নূর হোসেনের চলাফেরায়ও ছিল রাজকীয় ভাব।

যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল তার নেতৃত্বে থাকতেন নূর হোসেন। অবৈধ টাকা, ক্ষমতার দাপট ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় নির্বাচিত হয়েছিলেন সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর। এর আগে নির্বাচিত হন সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। জনপ্রতিনিধি হয়ে একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড থেকে কাঁচপুর সেতুর নিচে শীতলক্ষ্যা নদী পর্যন্ত ফুটপাত, বালুর ঘাট, ট্রাকস্ট্যান্ড, মাছবাজার, আন্তঃজেলা ট্রাক ইউনিয়ন, পরিবহন চাঁদাবাজি, যাত্রার নামে জুয়ার আসর, মাদক ব্যবসা। আর এসব দেখভাল করতেন তার ভাই, ভাতিজা ও সহযোগীরা।

শুরুটা হয় ১৯৮৫ সালে, সিদ্ধিরগঞ্জের ইকবাল গ্রুপের ট্রাকের হেলপার হিসেবে কাজ নেন নূর হোসেন। বছরখানেক পর হয়ে যান ট্রাকচালক। ১৯৮৭ সালে বাবা বদরুদ্দিন একটি পুরনো ট্রাক কিনলে সেটির চালক হন নূর। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ১৯৯২ সালে বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিনের আশীর্বাদে নির্বাচিত হন সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান। এর তিন বছর পর ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে আদমজিতে খালেদা জিয়ার জনসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দিয়ে প্রকাশ্যে রাজনীতিতে আসেন। তবে আলোচনায় আসেন তৎকালীন বিএনপি নেতা বর্তমানে এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের গাড়িতে বোমা হামলা চালিয়ে।

বাতাসের গতি বুঝে হাল ধরতে ভুল করেননি শ্রমিক নেতা নূর হোসেন। ১৯৯৮ সালে বিএনপি ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ২০০১ সালে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশে ফিরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় শুরু করেন মাদক ব্যবসা, পরিবহন চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলরও নির্বাচিত হন তিনি।
এর মধ্যেই তার পরিকল্পনায় ২০১৪ সালের এপ্রিলে হত্যা করা হয় কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে। আলোচিত এ ঘটনার পর নূর হোসেন, তার ভাই নূর সালাম, নূরুদ্দিন, নূরুজ্জামান জজ, ভাতিজা কাউন্সিলর শাহ জালাল বাদলসহ পরিবারের সবাই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে ভারতে গ্রেপ্তার হন নূর হোসেন। অন্যদিকে প্রায় এক বছর পর বাকি সবাই এলাকায় ফিরে আসে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনকে ম্যানেজ করে পুনরায় দখল নিতে শুরু করেন নূর হোসেনের ফেলে যাওয়া সাম্রাজ্য।

বর্তমানে নূর হোসেনের পরিবহন সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করছেন তার ছোট ভাই নূরুদ্দিন। শিমরাইল ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের মোড় থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তার পাশের ফুটপাত ও দোকানপাট থেকে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন তার ভাতিজা শাহ জালাল বাদল। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের পাথরঘাট নিয়ন্ত্রণ করেন নূরের ছোট ভাই নূরুজ্জামান জজ। প্রতিট্রাক লোড হলেই জজকে দিতে হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এমনকি নদীর ঘাটের ব্যবসায়ীদের মাসিক একটা চাঁদা দিয়ে তাদের ব্যবসা করতে হয় বলেও একাধিক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান। এ ছাড়া ভেজাল জায়গাজমি কেনাবেচার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন বড়ভাই নূর সালাম।

জানা গেছে, সড়ক ও জনপথ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিশাল জায়গা ও খাল দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল টিনশেড মার্কেট। প্রতিটি ঘর থেকে অগ্রিম নেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া ফুটপাত, ভাসমান রেস্তোরাঁ, বাস কাউন্টার, মুচির দোকান, মোবাইল এক্সেসরিজের দোকান, ফলের দোকান, ফ্লেক্সিলোডসহ প্রায় ৫০০ দোকান থেকে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ৪০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করছেন কাউন্সিলর শাহ জালাল বাদল। যদিও এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বর্তমান এই কাউন্সিলর।

এদিকে শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণে আছেন নূর হোসেনের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর আরিফুল হক হাসান। তাকে সহায়তা করেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। ট্রাকস্ট্যান্ডের প্রতিটি ট্রাক থেকে দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে আদায় করা হয় বলে অভিযোগ। এ ব্যাপারে মঙ্গলবার রাতে আরিফুল হক হাসানের বক্তব্য জানার জন্য তার মুঠোফোনে কয়েকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

তবে ঢাকা-দাউদকান্দি রোডে চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাসের কন্ডাক্টর বাসেদ জানান, আন্তঃজেলা পরিবহন সমিতির বাইরেও প্রতিদিন চট্টগ্রাম, সিলেট, দাউদকান্দি, নরসিংদী, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন দূরপাল্লা ও স্বল্প দূরপাল্লার পরিবহন থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন নূর হোসেনের ভাই নূরুদ্দিনের লোকজন। প্রতিটি বাস থেকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা এবং লেগুনা টেম্পো থেকে আদায় করা হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে। কোনো বাসের কন্ডাক্টর, হেলপার বা চালক চাঁদা দিতে না চাইলে মারধর করা হয়। আর শিমরাইল রেন্ট-এ কার স্ট্যান্ড ও টেম্পো স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন সাত খুন মামলার চার্জশিট থেকে বাদ পড়া সেচ্ছাসেবকলীগ নেতা আমিনুল হক রাজু। শ্রমিকলীগ নেতা সামাদ বেপারিসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাও আন্তঃজেলা পরিবহন সমিতির নামে চাঁদাবাজি করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

মূলত নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাত হত্যাকা-ের পরই মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের সন্ধান পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি দুদকের একটি দল সম্পদের খোঁজ করে নূর হোসেন ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। সূত্র জানায়, সিদ্ধিরগঞ্জে এ অপরাধীর বেশ কয়েকটি বাড়ি, মাছের খামার ও পরিবহন ব্যবসা রয়েছে। শিমরাইল মৌজায় ৩৭৩ নম্বর দাগে প্রায় ১১ শতাংশ জমির ওপর সাত কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণ করেন নূর হোসেন। এ বাড়ির দোতলাটি করা হয়েছে ডুপ্লেক্স। একই মৌজার ৭২ ও ৭৩ নম্বর দাগে ১০ শতাংশ জমির ওপর নির্মাণ করেছেন পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়তলা বাড়ি। একই এলাকায় ১০ তলা ফাউন্ডেশনের ওপর আরও একটি ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। রসুলবাগে সাড়ে ৮ কাঠা জমির ওপর রয়েছে সাততলা বিলাসবহুল ভবন। এ জমির অর্ধেকই সরকারি। তার মালিকানাধীন নারায়ণগঞ্জ-চিটাগাং রুটে চলাচলকারী এবিএস পরিবহনের লাক্সারি ৩২টি বাসও রয়েছে।

রাজধানীর গুলশান-২ এ লেকের বিপরীতে তিন হাজার ৬০০ স্কয়ার ফুটের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে নূর হোসেনের। এ ছাড়া বনানী ও ধানম-িতে আরও দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। গাড়ি আছে চারটি, যার মূল্য প্রায় ৮ কোটি টাকা। পাশাপাশি তিনি কমপক্ষে ৫০ বিঘা জমির মালিক। এর মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ আঁটি মৌজায় রয়েছে ২ বিঘা জমি। সানারপাড় এলাকায় প্রায় তিন বছর আগে কিনেছেন চার বিঘা জমি। মুক্তিনগরে তার রয়েছে ১৫ কাঠা জমি। শিমরাইলে নিজের বাড়ির পেছনে রয়েছে ৪০ বিঘার মৎস্য খামার। সবকিছুই এখন নিয়ন্ত্রণ করছে পরিবারের বাকি সদস্যরা।

এ ব্যাপারে সিদ্ধিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সাত্তার আমাদের সময়কে বলেন, এক মাস হলো এ থানায় আমি যোগদান করেছি। তাই নূর হোসেনের ভাই-ভাতিজাদের আমি এখনো ঠিকমতো চিনি না। ফুটপাত, পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজি বিষয়ে ওসি বলেন, এসব বিষয়ে কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সূত্র- দৈনিক আমাদের সময়।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৩ ঘণ্টা, ২৪ আগস্ট ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম