দেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে মহামারী করোনার তাণ্ডব। এই করোনাকালীন সময়েই দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে করোনা মোকাবিলায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহামারি মোকাবিলায় সামনের সারিতে কাজ করছে। মহামারিকে এখন পেছনে ফেলে দুর্নীতির অভিযোগ এবং মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব অনেকটাই সামনে চলে এসেছে। করোনা নিয়ন্ত্রণের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক নেতারা বলছেন, মহামারির মধ্যে স্বাস্থ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কাম্য নয়। সুন্দর পরিবেশ তৈরির জন্য দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
সাম্প্রতিক ঘটনায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। কেউ কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। কেউ অফিসে দেরি করে আসছেন। কেউ মনে করছেন, এই সময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পদায়ন না থাকায় সম্মানটা অন্তত বেঁচে গেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যকার দূরত্ব জানাজানি হয়ে গেছে। অনেকেই অপেক্ষা করে আছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ রিজেন্ট কেলেঙ্কারির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের চিঠির কী ব্যাখ্যা দেন, তা জানার জন্য।
করোনা মোকাবিলায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, ‘এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কাজের সমন্বয় খুব দরকার। সমন্বয় না হলে সময় নষ্ট হবে, উদ্যোগ জোরালো হবে না। করোনাযুদ্ধে আমরা পিছিয়ে পড়ব।’
মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও হিমশিম খাচ্ছে। আক্রান্ত ও মৃত্যু দুই-ই বাড়ছে। সংক্রমণের হার একের বেশি, অর্থাৎ বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে। গতকালও নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ছিল ২৩ শতাংশের বেশি। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ও সর্বাত্মক উদ্যোগ গত চার মাসে দেখা যায়নি। কবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে, কত দিন পর মানুষ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে, তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য পূর্বাভাস দেশের মানুষ পাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে অনিয়ম-দুর্নীতি এবং মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তর দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা বেশি হচ্ছে।
গতকালের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
রাজধানীর মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিচতলায় সমন্বিত নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে চার মাস আগে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলে আসছেন, দেশের কোনো দুর্যোগের সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এত বড় নিয়ন্ত্রণকক্ষ প্রতিষ্ঠা করেনি। গতকাল বুধবার বেলা একটার সময় নিয়ন্ত্রণকক্ষ প্রায় ফাঁকা দেখা যায়। একটি টেবিলে একজন কর্মকর্তাকে কাজ করতে দেখা যায়, অন্য টেবিলে দুজন গল্প করছিলেন, আরেকটি টেবিলে চারজনকে চা-কফি খেতে দেখা যায়। বাকি টেবিলগুলো ছিল একেবারে ফাঁকা। অন্য দিন এই কক্ষের প্রায় প্রতিটি টেবিলে চার-পাঁচজন করে কাজ করতে দেখা গেছে।
এই কক্ষের ঠিক ওপরে মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের কক্ষ। মহাপরিচালক কোনো বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাইলেন না। শুধু জানালেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে ব্যাখ্যা চেয়েছে, তা চূড়ান্ত করার কাজে ব্যস্ত।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাতজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। স্বাস্থ্যে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় এঁরা কেউ কেউ বিব্রত বোধ করছেন। অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘করোনা আর দুর্নীতির সাগরে পড়েছি। এখন ঠেলাঠেলি হচ্ছে মন্ত্রণালয় আর অধিদপ্তরের মধ্যে।’
অধিদপ্তরের শিক্ষা শাখার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে মুখ দেখানো তো দূরের কথা, ফোন ধরতেও লজ্জা করে। তারা হয়তো ভাবে, আমিও বুঝি জেকেজি বা রিজেন্ট কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত। অধিদপ্তরে আমার কোন শাখায় কী দায়িত্ব, তা তো তারা জানে না।’ একজন শীর্ষস্থানীয় নারী কর্মকর্তা বলেন, ‘বিব্রত হচ্ছি তো বটেই। কাজ করার স্পৃহা একেবারেই নেই।’
তবে কর্মকর্তারা বলেছেন, এক দিনে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। মহামারির সময় জমে থাকা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিস্ফোরণ ঘটেছে। একজন লাইন ডিরেক্টর বলেন, ‘কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও দলাদলি আছে। যোগ্যতার চেয়ে কে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) বা কে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নেতার লোক, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। কারও খুঁটির জোর অধিদপ্তরের বাইরে, কারও মন্ত্রণালয়ের বাইরে। কেউ কারও কাজ নজরদারিও করে না, করার ক্ষমতাও রাখে না।’
মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমএর মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেখছে তার মাথার ওপর অধিদপ্তর নেই। অধিদপ্তর দেখছে তার মাথার ওপর মন্ত্রণালয় নেই। মহা সর্বনাশা পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে স্বাস্থ্য খাত। এক্ষুনি ক্ষমতাধর অন্য পক্ষের হস্তক্ষেপ জরুরি।
এন৯৫ মাস্ক দিয়ে শুরু
সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে দেশবাসী জানে। সরকার সীমিত সম্পদ ঠিকভাবে ব্যবহার করবে, এটা অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল। দেশবাসী আশা করেছিল, অতীতে দুর্নীতি যা-ই হোক মহামারির সময় হবে না। দেশবাসী অন্য চিত্র দেখল।
প্রথম দুর্নীতির খবর আসে মাস্ক নিয়ে। ২ এপ্রিল এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানে বিশ্বসেরা এন৯৫ মাস্কের নামে নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের তখনকার পরিচালক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলেছিলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সুনাম নষ্ট করার জন্য অপবাদ ছড়ানো হচ্ছে।
অথচ মাস্ক নিয়ে তদন্তে দুর্নীতি ধরা পড়ে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অথচ মাস্কের মান নিয়ে প্রতিবাদ করায় দুজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
মানুষ যখন করোনা পরীক্ষা নিয়ে চরম ভোগান্তিতে আছে, তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে জেকেজির নকল পরীক্ষা সনদের বিষয়টি সামনে এল। এরপরই রিজেন্টের অনিয়ম দেশবাসীর সামনে হাজির হলো।
প্রশ্ন উঠেছে কার দোষ বেশি, তা নিয়ে। মন্ত্রণালয়ের, না অধিদপ্তরের। রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে ১১ জুলাই অধিদপ্তর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাসপাতাল বিভাগ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়।’ ১২ জুলাই সংবাদপত্রে তা ছাপা হয়।
ওই দিনই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বক্তব্যের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়ে অধিদপ্তরকে জরুরি চিঠি দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাতে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তা তিন কার্যদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যাসহ জানাতে বলা হয়।
গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে নানা কাজে দ্বৈধতা ও মতভিন্নতা আছে। যেমন করোনা নিয়ে ব্রিফিং শুরু থেকে করে আসছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা একই কাজ মন্ত্রণালয়ে শুরু করেন। একই ধরনের কমিটি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর গঠন করে। অধিদপ্তর গঠন করেছিল পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি। আর মন্ত্রণালয় গঠন করে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।
রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সই রয়েছে। সই অনুষ্ঠানের ছবি বেশ আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। দেখা যাচ্ছে, অনুষ্ঠানে অন্যান্যের সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, মন্ত্রীর পেছনে আগের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম, হাসপাতাল শাখার পরিচালক আমিনুল হাসান ছিলেন। মন্ত্রীর ডান পাশে রিজেন্টের মালিক, বাঁ পাশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুরোধে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তির অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন। তবে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে কোনো সমস্যা আছে বলে তিনি মনে করেন না। হয়তো সাময়িক একটা ভুল-বোঝাবুঝি হতে পারে। আর সেটার জন্য কোনো স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।
রিজেন্ট হাসপাতালের কাজের অভিজ্ঞতাও ভালো ছিল না বলে জানিয়েছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকেরা। ওই ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকদের পদায়ন করা হয়েছিল রিজেন্টের মিরপুর শাখায়। হাসপাতালে কাজের পরিবেশ না থাকার বিষয়টি তাঁরা অধিদপ্তরকে জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ ৭ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে রিজেন্টের দুর্নীতির কথা বলেছিলেন। কোনো ব্যবস্থা নেয়নি অধিদপ্তর।
এসব কথা ও ঘটনায় মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, এসব ঘটনা করোনা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দ্বন্দ্বের কারণে লাল, হলুদ ও সবুজ এলাকা চিহ্নিত করে ছোট ছোট লকডাউন করার সিদ্ধান্ত আটকে আছে। বারবার চেয়েও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রোগ সংক্রমণের সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিতে পারছে না। পরীক্ষার মান নির্ধারণে মানসম্মত কার্যপ্রণালিবিধি (এসওপি) তৈরির কথা ছিল, তাও আটকে আছে।
বর্তমান পরিস্থিতিকে অস্বস্তিকর বলে বর্ণনা করেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর পরস্পরমুখী অবস্থান নিয়েছে। আমরা অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়েছি। সমন্বয়হীনতার যে অভিযোগ ছিল, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতে অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের ওপর মানুষের অনাস্থা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’
অধ্যাপক উত্তম কুমার বড়ুয়া, অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লাসহ সবাই বলছেন, দ্রুত এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার কার্যকরভাবে করোনা মোকাবিলার স্বার্থে।
: প্রথম আলো