মহামারী করোনাভাইরাসে সৃষ্ট এমন সংকট পৃথিবী অতীতে আর দেখেনি। মহামারীতে স্থবির হয়ে পড়েছে ধনী-গরিব প্রায় সব রাষ্ট্র। বিশ্ব সংকটের এই ঢেউ আচড়ে পড়েছে বাংলাদেশেও। এই বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলায় তৎপর পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংকট নিরসনে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন রাত-দিন। মানুষের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি জীবিকা নিশ্চিতে নিয়েছেন একের পর এক পদক্ষেপ। অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে তিনি ঘোষণা করেছেন নানা প্রণোদনা।
গণভবন থেকেই সবকিছু কঠোর মনিটরিংয়ে রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সমস্যা সমাধানে তিনি তাৎক্ষণিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের সব জেলা প্রশাসন, দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, সামাজিক এবং ধর্মীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। স্থানীয় প্রশাসনকে তাৎক্ষণিক পরামর্শ দিয়েছেন। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় এ রকম সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ফোর্বস ম্যাগাজিনসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং সংস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছে।
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাস মহামারী পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তিনি গণভবনে নিয়মিত অফিস করছেন, ফাইলপত্র সই করছেন এবং পাশাপাশি অন্যান্য সব সেক্টরের খোঁজখবর রাখছেন। দেশের মানুষের জীবন এবং অর্থনীতিকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হচ্ছে দুটো বিষয়। একটা হচ্ছে জীবন, আরেকটা হচ্ছে জীবিকা। প্রধানমন্ত্রী সবকিছু সমন্বয় করছেন। তিনি সবার সঙ্গে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। প্রতিদিনই তিনি বিভিন্ন জনের সঙ্গে বৈঠক করছেন। ব্যাংকিং বিষয়, অর্থনৈতিক বিষয় বা স্বাস্থ্য বিষয়সহ সবকিছুর তিনি সর্বশেষ তথ্য নিচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন। পাশাপাশি চীনের প্রেসিডেন্ট, ইউরোপীয় দেশগুলো তথা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রী কথা বলছেন।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের জীবন ও জীবিকাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একে ‘মানুষের জীবন রক্ষার বাজেট’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তায় আনার জন্য বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে গত অর্থ বছরের তুলনায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অর্থনীতি ও জীবন বাঁচাতে যত পদক্ষেপ : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার বন্ধ ঘোষণা করা হয়। দফায় দফায় বাড়ানো হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ। আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ থাকবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনির্দিষ্টকালের জন্য এইচএসসি ও সমমানের পাবলিক পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়েছে। অনলাইন ও টেলিভিশনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সাধারণ ছুটি কয়েক দফা বাড়িয়ে ৩০ মে পর্যন্ত তা বলবৎ রাখা হয়। চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনসহ করোনা যুদ্ধে ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের জন্য পিপিই-মাস্কসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত করা হয়। টেস্টিং কিট আমদানি ও পরীক্ষার ব্যবস্থার পাশাপাশি সারা দেশে ৬৮টি ল্যাব থেকে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হচ্ছে। যেসব সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যক্ষভাবে করোনাভাইরাস রোগীদের নিয়ে কাজ করছেন তাদের বিশেষ সম্মানী দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি সদস্য এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্য কর্মচারীদের জন্য দায়িত্ব পালনকালে কেউ আক্রান্ত হলে পদমর্যাদা অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য থাকছে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবীমা। মৃত্যুর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৫ গুণ হিসেবে স্বাস্থ্য ও জীবন বীমা ঘোষণা করা হয়েছে। এ জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট বিদেশি সংস্থা, চিকিৎসক পেশার প্রতিনিধিসহ সবাইকে নিয়ে ‘জাতীয় কমিটি’ এবং ‘কভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক’ কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুই হাজার ডাক্তার ও ৫ হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা এরই মধ্যে কাজে যোগ দিয়েছেন। অচিরেই আরও ৫ হাজার স্বাস্থ্য টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া হবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ তথ্য ও চিকিৎসাসেবা প্রদানে হটলাইনে যুক্ত চিকিৎসক সংখ্যা ৩ হাজার ৯৬৪ জন। তিনটি হটলাইনে (১৬২৬৩; ৩৩৩ ও ১০৬৫৫) তারা চিকিৎসা এবং অন্যান্য পরামর্শ দিচ্ছেন। এ ছাড়া বিভাগ, জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ১ এপ্রিল ৩১টি, ১৬ এপ্রিল ১০টি, ২০ এপ্রিল ১৩টি এবং ২৭ এপ্রিল ১০টি নির্দেশনা দেন। ১৫ মার্চ কভিড-১৯ ঠেকানোর লড়াইয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে সার্ক নেতাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে গণভবন থেকেই যোগ দেন শেখ হাসিনা। ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে ১৯টি প্যাকেজে ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। প্যাকেজে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক এবং পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনকে ২ হাজার কোটি টাকার তহবিল প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের সংস্থাগুলোর জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) এবং মাঝারি শিল্পের চলতি মূলধন সরবরাহের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনাা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। করোনাভাইরাস মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাদের গেল দুই মাসের সুদের চাপ কমাতে ২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়। কৃষিতে ভর্তুকি ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, কৃষি পুনঃতফসিল প্রকল্পে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে।
স্বল্প আয়ের কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পুনরায় ফিন্যান্সিং স্কিম ৩ হাজার কোটি টাকা, ১০ টাকা কেজি চাল বিক্রি বাবদ ২৫১ কোটি টাকা, নির্দিষ্ট কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে নগদ বিতরণ ১ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। ভিজিডি, ভিজিএফ, ১০ টাকায় খাদ্য সহায়তা ও অন্যান্য সহায়তা প্রাপ্ত প্রায় ৭৬ লাখ পরিবার বাদ দিয়ে অবশিষ্ট প্রায় ৫০ লাখ করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে মে মাসে এককালীন ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে মোট ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা নগদ সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
৫০ লাখ মানুষের জন্য রেশন কার্ড করা আছে, যারা ১০ টাকায় চাল পান। নতুন আরও ৫০ লাখ রেশন কার্ড করে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এতে প্রায় ৫ কোটি মানুষ উপকৃত হবেন। ত্রাণ কার্যক্রম তদারকির জন্য দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রায় ৪৬ হাজার গ্রামপুলিশকে (দফাদার ও মহল্লাদার) ১ হাজার ৩০০ টাকা করে ৬ কোটি টাকা বিশেষ অনুদান দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ পর্যন্ত সারা দেশে সোয়া ১ কোটির বেশি পরিবারের ৬ কোটির বেশি মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র রমজান উপলক্ষে কওমি মাদ্রাসাগুলোকে ৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন কওমি মাদ্রাসার নেতারা। ঈদুল ফিতর সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা দেশে আরও ৬ হাজার ৯৭০টি কওমি মাদ্রাসাকে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন। ঈদের আগে সারা দেশের মসজিদগুলোর জন্য ১২২ কোটি ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে।