দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। বাড়ছে সংক্রমণের ঝুঁকি ও মৃত্যু। গত বৃহস্পতিবারের পর থেকে প্রতিদিনই দ্বিগুণ হারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এমনকি গত তিন দিন ধরে আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড ভাঙছে রোগটি। গতকাল এক দিনেই নতুন ৩৫ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। নতুন নতুন এলাকায় করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। সরকার কমিউনিটিতে সীমিত আকারে রোগটি ছড়িয়ে পড়ার কথা স্বীকার করলেও এলাকাভিত্তিক সংক্রমণের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সংক্রমণ ঠেকাতে প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো এলাকা ও বাড়িঘর লকডাউন ঘোষণা করা হচ্ছে। সর্বশেষ এই মুহূর্তে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা থেকে বের হওয়া ও ঢাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আক্রান্ত ও মৃত্যুর পাশাপাশি বাড়ছে সংক্রমণের ঝুঁকি। বিশেষজ্ঞরা সংক্রমণের জন্য যে সব কারণকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন, ধীরে ধীরে সে সব কারণও বাড়ছে। বিশেষ করে দেশের পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণায় গত শনিবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকা ও এর আশপাশে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জে ফেরা শ্রমিকদের ঢল, দেশজুড়ে করোনার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পরে শনিবার মধ্যরাতেই কারখানা পুনরায় বন্ধের ঘোষণার ফলে এসব শ্রমিকের মাধ্যমে এসব এলাকায় রোগটি সংক্রমণের ঝুঁকি স্থায়ী হয়ে গেল।
এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক, সংসদ সদস্য সালাম মুর্শেদীসহ আরও কয়েকজন এবং বাণিজ্যমন্ত্রীকে সরাসরি দায়ী করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি বলেন, এ ঘটনার কারণে শ্রমিকদের মাধ্যমে সারা দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার লাভ করবে।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো কারও দেহে সংক্রমণ ধরা পড়ে। গতকাল এক দিনে মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের এবং আক্রান্তের সর্বোচ্চ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫ জনে। আক্রান্তদের মধ্যে মোট ৩৩ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ৭০৯ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে এবং ৩০ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত দেশে ৬৬ হাজার ৫১১ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে এবং ২৯৯ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। সর্বমোট ৬৬ হাজার ৮১০ জনকে কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ২৩ জনকে আইসোলেশনে নেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট ৪৪৩ জনকে আইসোলেশনে নেওয়া হয়। অনেককে ছাড়পত্র দেওয়ায় বর্তমানে ১০৭ জন আইসোলেশনে রয়েছেন।
গতকাল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে অনলাইন ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, নতুন আক্রান্ত ৩৫ জনের মধ্যে ১১ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছর, এরপর ৬ জন ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী। এলাকাভিত্তিক বিশ্লেষণে দেশে শনাক্তকৃত মোট ১২৩ জন করোনা রোগীর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৬৪ জন রাজধানী ঢাকার। এ পর্যন্ত সারা দেশ থেকে ৪ হাজার ১১ জন ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, যার মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৬৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এ নমুনার সবগুলোই পরীক্ষা করা হয়েছে বলে জানান তিনি। আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশের ১৫টি জেলায় কেইস পেয়েছি। যেখানে একাধিক ব্যক্তি আছেন এবং এক জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছেন সেসব জায়গাকে আমরা ক্লাস্টার বলছি।
এ ধরনের ব্যবস্থা (ক্লাস্টার) হতে পারে ঢাকা মহানগরী, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর, গাইবান্ধায়। আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা গতকাল ব্রিফিংয়ে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় যাদের সংক্রমণ আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি তাদের ১২ জন নারায়ণগঞ্জের। নারায়ণগঞ্জে ক্লাস্টার হিসেবে চিহ্নিত করেছি, সেখানে বেশ কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, যাতে ওখান থেকে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ে। পরবর্তীতে রয়েছে মাদারীপুর এলাকা। নারায়ণগঞ্জের দুই রোগীই হাসপাতালে আসার কিছুক্ষণ পর মারা যান বলে জানান ফ্লোরা। তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জের যে দুজন মারা গেছেন, সঙ্গে সঙ্গেই তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিং শুরু করেছে আইইডিসিআর। এ পর্যন্ত তাদের কন্টাক্টে যতজন পাওয়া গেছে তাদের সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, পুরো নারায়ণগঞ্জকে হটস্পট হিসেবে আইডেন্টিফাই করে সেখানে কোয়ারেন্টাইন কার্যক্রমকে আরও বেশি শক্তিশালী করার জন্য আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। ওখানে প্রশাসন আমাদের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। রোগী যখন চিহ্নিত হয় তখন থেকেই আমরা কোয়ারেন্টাইন কার্যক্রম শুরু করি। রোগী জীবিত না মৃত সেটা কিন্তু বিবেচনার বিষয় নয়। কারণ কোয়ারেন্টাইন করা হয় যাতে সংক্রমণ ছড়িয়ে না পড়ে। সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ১২৩ জনের গত ২৪ ঘণ্টায় সে ৩৫ জন আক্রান্ত রোগীর কন্টাক্ট ট্রেসিং চলছে। এদের কারও কন্টাক্ট ট্রেসিং কমপ্লিট হয়ে যায়নি। যারা মিসিং কন্টাক্ট তাদের নাম তালিকাভুক্ত থাকে। ১২৩ জনের মধ্যে বিভিন্ন রকমের কন্টাক্টের সংখ্যা রয়েছে। কন্টাক্ট ট্রেসিং প্রক্রিয়াটি কিন্তু খুব সহজ নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা সব কন্টাক্টকে ট্রেস করতে পারি। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেটা হয়..কেউ যদি গণমাধ্যমের চলাফেরা করে থাকেন সেই মুহূর্তে অথবা এমন কোনো অনুষ্ঠানে গেছেন যেখানে বড় সমাবেশ ছিল সেক্ষেত্রে কিছু মিসিং কন্টাক্ট থাকে। আমাদের হিসাবের মধ্যে মিসিং কন্টাক্ট কতজন সেটাও আমরা তালিকাভুক্ত করে সে এলাকাটিও কনটেইনমেন্টের মধ্যে নিয়ে আসি। ক্লাস্টার এলাকার বিষয়ে ফ্লোরা বলেন, যদি কোথাও একই জায়গায় কম দূরত্বের মধ্যে একাধিক রোগী থাকে তখনই আমরা সেটাকে ক্লাস্টার হিসেবে আইডেন্টিফাই করে ইনভেস্টিগেশন করে থাকি।
ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, করোনা প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে চলুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। প্রয়োজনে বাসা থেকে বের হলেও মাস্ক ব্যবহার করুন। মন্ত্রী বলেন, অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমরা রাস্তাঘাটে, বাজারে অনেক লোক সমাগম দেখছি। এটা যেন কোনোভাবেই কাম্য নয়। যারা দরিদ্র লোকদের ত্রাণ দিচ্ছেন তাদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা ত্রাণ মানুষের বাসায় পৌঁছে দেবেন। তাহলে জনসমাগম এড়ানো সম্ভব হবে। জাহিদ মালেক বলেন, সরকারি হাসপাতালে সব ধরনের চিকিৎসা চলছে। কুয়েতমৈত্রী, কুর্মিটোলা এবং গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত পিপিই সরবরাহ রয়েছে। এসবের কোনো সংকট নেই। বেসরকারি পর্যায়ের চিকিৎসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা রোগীদের সেবা দিন, সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকলে আমাদের বলুন। আমরা ব্যবস্থা করব। এই সময়ে রোগীদের ফেলে আপনারা দূরে থাকবেন না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৫০২টি পিপিই সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ৪ লাখ ১১ হাজার ৩৩৯টি বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়েছে এবং ৫৮ হাজার ১৬৩টি মজুদ আছে। পরীক্ষার কিট সরবরাহ করা হয়েছে ২১ হাজার এবং মজুদ আছে ৭১ হাজার। তিনি জানান, বর্তমানে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ১২ হাজার ৫৮০ জন, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আছেন ৭৯ জন। বর্তমানে আইসোলেশনে আছেন ৮৪ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন হটনম্বরে ফোনকল এসেছে ৯৭ হাজার ৯৪৮টি। এছাড়া এ পর্যন্ত ৯১৫ জন চিকিৎসক এবং ৯৮ জন নার্স কোভিড-১৯ সংক্রান্ত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও হাসপাতাল সংক্রমণ এবং নিয়ন্ত্রণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।