দেশে দ্বিগুণ হারে বাড়ছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। গতকাল এক দিনেই নতুন ৩৫ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গার্মেন্ট কারখানা খোলা রাখা না রাখা নিয়ে সমন্বয়হীনতা এবং শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে তাদের আবার ঢাকায় নিয়ে আসা এবং ফেরত পাঠানোর ঘটনায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক, সংসদ সদস্য সালাম মুর্শেদীসহ আরও কয়েকজন এবং বাণিজ্যমন্ত্রীকে সরাসরি দায়ী করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি বলেন, এ ঘটনার কারণে শ্রমিকদের মাধ্যমে সারা দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার লাভ করবে। গতকাল গণভবনে ক্ষুদ্র পরিসরে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি এই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরও কঠোর হওয়ারও নির্দেশ দেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া বৈঠকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর ও গাইবান্ধা পূর্ণাঙ্গ লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের ভয়াবহ বিস্তার এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই সপ্তাহ বিরতির পর গতকাল ছ্টো আকারে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাত্র সাত জন মন্ত্রিসভায় অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি সংক্ষিপ্ত সময়ে শেষও হয়ে যায়। এক ঘণ্টারও কম সময় চালা বৈঠকের বেশিরভাগ সময়ই করোনাভাইরাস এবং পোশাক কারখানা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে গার্মেন্ট কারখানার ছুটি এবং শ্রমিকদের ঢাকা থেকে চলে যাওয়া ও আবার ফিরে আসার প্রসঙ্গ তুলে নিজেই আলোচনার সূত্রপাত করেন। এ সময় তিনি বলেন, প্রথমে গার্মেন্ট কারখানা ছুটি দেওয়া হলো। শ্রমিকরা বাড়ি চলে গেল। সরকার সাধারণ ছুটির সময়সীমা বাড়াল। কিন্তু গার্মেন্ট কারখানার মালিকরা সেটি দেখলেন না। তারা ৫ এপ্রিল কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে শ্রমিকদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। তিনি গার্মেন্ট মালিকদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সারা দেশে সাধারণ ছুটি থাকার পরও কার নির্দেশে, কার পরামর্শে শ্রমিকদের ঢাকা নিয়ে আসা হলো? রাতে কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে তাদের গ্রামের পথে আবার ফেরত পাঠানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের এই পরিস্থিতিতে সমন্বয় ছাড়া গার্মেন্ট খোলা এবং শ্রমিকদের ঢাকায় নিয়ে আসার ফলে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটছে। এই পরিস্থিতির জন্য প্রধানমন্ত্রী সরাসরি গার্মেন্ট কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক, সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য সালাম মুর্শেদী, উপ-নির্বাচনে ঢাকা থেকে সদ্য নির্বাচিত এক সংসদ সদস্য এবং বাণিজ্যমন্ত্রীকে দায়ী করেন। এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করে বলেন, আমি গার্মেন্ট মালিকদের নিয়ে বসেছিলাম। তাদেরকে পুরো পরিস্থিতি তুলে ধরে গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ করার কথাও বলেছিলাম। কিন্তু তারা শোনেননি।
বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাৎক্ষণিকভাবে বৈঠকে উপস্থিত মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও তার মুখ্যসচিবকে নির্দেশ দেন, বিকালের মধ্যে গার্মেন্ট খাতের সংশ্লিষ্ট নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে বৈঠকে করে দেশের গার্মেন্ট কারখানা খোলাসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তারা সুনির্দিষ্ট একটি বিধান করবেন। একই সঙ্গে তিনি এ নির্দেশনাও দেন যেসব কারখানা মাস্ক, পিপিইসহ এমন পণ্য তৈরির সঙ্গে যুক্ত শুধু তাদের কারখানা খোলা থাকবে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যান্য দেশের যে পরিস্থিতি তাতে বাংলাদেশও ঝুঁকিমুক্ত নয়। সামনের দিনগুলো আরও বিভীষিকাময়। এ জন্য সরকারের নিয়ম-কানুন মানাতে সংশ্লিষ্টদের আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক মন্ত্রী বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে এবং পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুরোপুরি লকডাউনসহ আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রীকে। তাদের বক্তব্য ও পরামর্শ প্রধানমন্ত্রী মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন, তবে কোনো কথা বলেননি।
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, এখন (গতকাল সোমবার) রাজধানী ঢাকায় কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। বাহির হতেও পারবে না। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন বৈঠক থেকেই। তবে খুব জরুরি প্রয়োজনে কেউ যদি বাহির হতে চান এবং উপযুক্ত কারণ দেখাতে পারেন তাহলে তাকে ছাড়া হবে। অন্যথায় সবার ক্ষেত্রেই সমান আদেশ প্রযোজ্য হবে।
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কারাগারে আটক লঘুদে সাজাপ্রাপ্ত এবং দীর্ঘদিন ধরে আটক হাজতিদের ছেড়ে দেওয়া যায় কি না। এ ব্যাপারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা চান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে দ্রুত প্রস্তাব পাঠানোর নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্ষণ মামলা, এসিড ছোড়ার মামলা এবং খুনের মামলার আসামিদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে না। এ বিষয়টি বিশেষ নজর রাখতে হবে।