বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি ও বাংলাদেশে আক্রান্ত কয়েক জন শনাক্তের ঘটনায় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার দাবি জোরালো হচ্ছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে শনিবার থেকে সব বিভাগের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, চুয়েটসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন শুরু করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরাও বিবৃতি দিয়ে ছুটি ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন।
করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, না–করা নিয়ে সরকারের মন্ত্রী ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা একেকজন একেক কথা বলছেন। কিন্তু যে যা–ই বলুন, রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উপস্থিতি কমে আসছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেছেন, ‘স্কুল-কলেজ বন্ধের বিষয়টি আমাদের উচ্চপর্যায়ে আলোচনায় আছে। আমাদের ভাবনায়ও আছে। আমরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি, সময়মতো বিষয়টির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এত দিন বলে আসছিল এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু গতকাল রোববার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হবে নাকি বন্ধ রাখা হবে, সেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিষয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবশ্য গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।
নীতিনির্ধারকেরা নানা কথা বললেও শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ইতিমধ্যে করোনা–আতঙ্কে স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ক্লাসে যাওয়া থেকে বিরত থাকছেন। অনতিবিলম্বে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ ঘোষণা কিংবা গ্রীষ্মকালীন ছুটি নির্ধারিত সময়ের আগে কার্যকর করার নির্দেশনা দিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সমিতিগুলোর মোর্চা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন।
গতকাল সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক জরুরি সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কাছে সাংবাদিকেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়, এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় নেবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হবে কি না, সে বিষয়ে গতকাল বিকেলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে কিন্তু কোনো স্থানীয় পর্যায়ে সংক্রমণ নেই। বিদেশ থেকে রোগী আসা বা কেউ সংক্রমণ বহন করে নিয়ে আসা বন্ধ করার চেষ্টা করছি আমরা। তবে যদি কখনো এমন অবস্থা দেখা যায় যে স্থানীয় পর্যায়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন বোধে স্কুল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হবে। এখন পর্যন্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ করার কোনো কারণ ঘটেনি।’
স্কুল–কলেজে উপস্থিতি কম
গতকালও রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি কম ছিল। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম গতকাল তাঁর প্রতিষ্ঠানে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ উপস্থিতির কথা জানান। অনেক অভিভাবক সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফওজিয়া বলেন, গতকাল চতুর্থ শ্রেণির প্রভাতি শাখায় উপস্থিতি কম ছিল। আর দিবা শাখায় উপস্থিতি ছিল ৫০ শতাংশের বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বর্জন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৬টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের মধ্যে অন্তত ৪০টির শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত রাখাসহ বিভিন্ন দাবিতে গতকাল উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা। এর আগে রাজু ভাস্কর্যের সামনে তাঁরা একটি মানববন্ধনও করেন। ক্যাম্পাস বন্ধের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গত শনিবার সন্ধ্যা থেকে অনশন করছেন চার ছাত্র।
একই দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও ছাত্র অধিকার পরিষদ।
স্কুল-কলেজে উপস্থিতি কম। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বর্জন। ছুটির দাবি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের।
তবে উপাচার্য আখতারুজ্জামান বলেন, ক্যাম্পাস ছুটির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি শিক্ষার্থীদের সতর্ক ও সচেতন থাকার আহ্বান জানান।
বুয়েটের শিক্ষার্থীরা আগের দিনের মতো গতকালও কোনো ক্লাস করেননি। এ বিষয়ে ছাত্রকল্যাণ পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীরা না আসায় ক্লাস হচ্ছে না। তবে ছুটির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাস বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। গতকাল বেলা ১১টায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনের পাশে মানববন্ধন করেন তাঁরা। এ সময় অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে বক্তব্য দেন। এ ছাড়া গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সব বর্ষের শিক্ষার্থীরা আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তবে সরকারি নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মানুযায়ী চলবে বলে জানিয়েছেন জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক প্রভাষ কুমার কর্মকার।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (রুয়েট) শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমেছে। এ বিষয়ে ছাত্রকল্যাণ পরিচালক রবিউল আওয়াল জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কম হলেও অনেকেই ক্লাসে আসছে। তাই ক্যাম্পাস খোলা থাকবে, যারা ক্লাস করতে চায় তারা আসবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আজ থেকে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষের শ্রেণি প্রতিনিধিরা নিজেদের মধ্যে এক আলোচনা সভায় এ সিদ্ধান্ত নেন। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তৌসিফ মাহমুদ এ তথ্য জানিয়ে বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস বর্জন চলবে। গতকাল দুই বিভাগের শিক্ষার্থীরা মিডটার্ম পরীক্ষা ও ছয়টি বিভাগ ক্লাস বর্জন করেন। এ সিদ্ধান্তের প্রতি সংহতি জানিয়েছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ও ছাত্র অধিকার পরিষদ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মীজানুর রহমান বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়টি সরকার দেখছে। কোনো সিদ্ধান্ত এলে সবাই জানতে পারবে।
ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদের শিক্ষার্থীরাও ক্লাস বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনুষদের ছাত্র সমিতির নেতারা গণস্বাক্ষর নিয়ে এ সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়েছেন। তবে সরকারের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন উপাচার্য লুৎফুল হাসান।
গতকাল ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেননি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষার্থীরা। অনেকে হল ছাড়তে শুরু করেছেন। তাঁরা শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। বিভাগগুলো হলো যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ইতিহাস, উদ্ভিদবিজ্ঞান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।
ছুটির বিষয়টি আদালতে
করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে রিট করা হয়েছে। দেশের সব বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং স্থলসীমান্তে করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্তে তদারকি দল রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা চেয়েছেন রিটকারী আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ বিষয়ে আজ সোমবার শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে।