\’বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন\’

বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে জঙ্গিরা। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের ছয় সদস্যকে গ্রেফতারের পর এমন তথ্য জানা গেছে। র‌্যাবের অভিযানে রাজধানীর উত্তরা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে তারা গ্রেফতার হন। হামলা কিভাবে বাস্তবায়ন হবে সে পরিকল্পনা করতেই উত্তরা এলাকায় তারা মিলিত হয়েছিল বলে জানা গেছে।

এদিকে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের টার্গেট করছে বাংলাদেশের নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো। তাদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লা বাংলা টিম (এবিটি) ও তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকারী ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। তবে তা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে তত্পর। সাম্প্রতিককালে জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও গোয়েন্দা তথ্যে জানা যায়, রোহিঙ্গারা জঙ্গিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। তাদের পেছনে সামান্য টাকা খরচ করলেই তাদেরকে ব্যবহার করা যায়। রোহিঙ্গাদের দলে ভেড়াতে জঙ্গি সংগঠনগুলো ব্যাপক তত্পরতা চালাচ্ছে।

এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, রোহিঙ্গাদের চাহিদা কম। সহজে তাদেরকে বশে আনা যায়। তাই জঙ্গিরা যাতে কোনো অবস্থাতেই রোহিঙ্গাদের কাছে যেতে না পারে বা সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে।

র‌্যাব-৪ গত শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে শনিবার সকাল ৭টা পর্যন্ত উত্তরা, গাজীপুর ও সাতক্ষীরার শ্যামনগরে অভিযান চালিয়ে ঐ ছয় জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন : নীলফামারীর শফিকুল ইসলাম ওরফে সাগর ওরফে সালমান মুক্তাদির (২১), পিরোজপুরের ইলিয়াস হাওলাদার ওরফে খাত্তাব (৩২), সাতক্ষীরার ইকরামুল ইসলাম ওরফে আমীর হামজা (২১), আমীর হোসাইন ওরফে তাওহীদি জনতার আর্তনাদ (২৬), শিপন মীর অরফে আব্দুর রব (৩৩) এবং চাঁদপুরের ওয়ালিউল্লাহ ওরফে আব্দুর রহমান (২৫)। গতকাল র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম এ তথ্য জানিয়েছেন।

গ্রেফতারকৃতদের কাছ হতে আনসার আল ইসলামের বিভিন্ন ধরনের উগ্রবাদী বই, লিফলেটসহ উগ্রবাদী ডিজিটাল কনটেন্ট, মোবাইল ও ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃত জঙ্গি শফিকুল ইসলামের সাংগঠনিক নাম সাগর সালমান মোক্তাদির। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, তিনি বর্তমানে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পঞ্চম বর্ষের ছাত্র। ইলিয়াস হাওলাদার নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে অ্যাপসের মাধ্যমে আলাপকালে আনসার আল ইসলাম সম্পর্কে প্রথম জানতে পারেন এবং তাদের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দলে যোগদান করেন।

গ্রেফতার ইলিয়াস হাওলাদারের সাংগঠনিক নাম খাত্তাব। অনলাইনে তিনি খাত্তাব ছদ্মনাম ব্যবহার করে জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি পেশায় চালক। ছাত্রজীবনে তিনি হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গ্রেফতার ইকরামুল ইসলামের সাংগঠনিক নাম মুত্তাকিন ওরফে আমীর হামজা ওরফে সালাউদ্দিন আইয়ুবী।

তিনি জানান, তার বাড়ি শ্যামনগরের সুন্দরবন সংলগ্ন চকবারা এলাকায়। বর্তমানে একটি মোবাইল কোম্পানির টাওয়ারে জেনারেটর পরিচালনার কাজ করছেন। পার্শ্ববর্তী গ্রামের আমির হোসাইনের মাধ্যমে তিনি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তীতে অনলাইনে বিভিন্ন জঙ্গি সংক্রান্ত পোস্ট ডাউনলোড করেন এবং বিভিন্ন জঙ্গির সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি জঙ্গি সংগঠনকে বিভিন্নভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। গ্রেফতার জঙ্গি আমির হোসাইনের সাংগঠনিক নাম সুলতান মাহমুদ ওরফে রাজা। তার বাড়ি শ্যামনগর থানাধীন। তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসা হতে হাফেজি পাশ করেন। জসিম উদ্দিন রাহমানীর বিভিন্ন রকম জঙ্গিবাদি আলোচনা তাকে আকৃষ্ট করে।

গ্রেফতার শিপন মীরের সাংগঠনিক নাম আব্দুর রউফ। পেশায় চালক। ইলিয়াস হাওলাদারের সঙ্গে আপসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ‘আনসার আল ইসলাম’ সম্পর্কে প্রথম জানতে পারেন এবং তাদের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দলে যোগদান করেন। তিনি প্রায় তিন বছর ধরে এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতার ওয়ালি উল্লাহর সাংগঠনিক নাম আব্দুর রহমান। বর্তমানে তাহফিজুল কুরআন/দারুল কুরআন ওয়াজ সুন্নাহ্ হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক। সূত্রাপুরের একটি মাদ্রাসা থেকে দাওরা হাদিস পাশ করে ২০১৮ সালে তাহফিজুল কুরআন/দারুল কুরআন ওয়াজ সুন্নাহ্ হাফিজিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০১৬ সালে সূত্রাপুর মাদ্রাসায় থাকাকালে আব্দুল্লাহ নামের এক ব্যক্তির সাথে পরিচয় হয়। তিনি তার মাধ্যমে আনসার আল ইসলামের ব্যাপারে প্রথম জানতে পারেন। তাদের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দলে যোগদান করেন।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গি সংগঠনগুলোর অপতত্পরতা বেড়েছে। জেএমবি ও এবিটির বেশ কয়েক নেতা চট্টগ্রাম এবং ভারত-বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান নিয়ে রোহিঙ্গা যুবকদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে শিক্ষিত ও ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন যুবকদের টার্গেট করছে জেএমবি ও এবিটির কয়েক নেতা। বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুফতি ও আলেমদের নিজেদের সংগঠনে যুক্ত করে সাংগঠনিক সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকারী একটি বেসরকারি সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের বিবদমান দুটি সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের রিক্রুটিং কর্মকাণ্ড সহজেই পরিচালনা করতে পারছে। জঙ্গি কর্মকাণ্ড নজরদারি করা একটি সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর তত্পরতার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও পাকিস্তানভিত্তিক একটি জঙ্গি সংগঠনের কয়েক নেতা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করছেন। পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘কক্সবাজারে ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার জন্য মোটা অঙ্কের বিদেশি সাহায্য আসে। এই টাকার ভাগ নিয়ে উগ্রপন্থি সংগঠনের নেতারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের নানাভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করে থাকেন।

র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, জঙ্গিরা বড়ো ধরনের হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এটা আমাদের গোয়েন্দাসূত্রে জেনে র্যাব কার্যক্রম শুরু করে দেয়। দুর্ধর্ষ ছয় জঙ্গিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়। এর ফলে বড়ো ধরনের একটি হামলার প্রস্তুতি র্যাব নস্যাত্ করে দেয়। জঙ্গি মাথাচাড়া দিলেই র্যাবের নেটওয়ার্কে ধরা পড়ে যাবে। রোহিঙ্গাদের টার্গেট সম্পর্কে র্যাবের মহাপরিচালক বলেন, রোহিঙ্গাদের যদি জঙ্গি কার্যক্রমে ভেড়াতে পারে তাহলে শুধু বাংলাদেশ নয় এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বড়ো হুমকি হবে। জঙ্গিরা যাতে কোনো অবস্থাতে রোহিঙ্গাদের কাছে যেতে না পারে সে ব্যাপারে র্যাবের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতাবস্থায় রয়েছে।

Scroll to Top