ইতি মল্লিক
২০১৫ সালের মে মাসে আলেপ্পোতে সিরিয়ান আর্মির একজন স্নাইপার যখন হোসেম কাতানকে গুলি করে, তখন তার শরীর বিবশ হয়ে পড়েছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন না বুলেটটা তার শরীরের কোন জায়গায় আঘাত করেছে। তিনি আশা করছিলেন এটা উরুর বা চোখের কোন ক্ষতি করেনি। পাঁচ বছর ধরে সিরিয়ার সংঘাতের চিত্র ক্যামেরায় বন্দী করতে করতে তিনি অনেক সহকর্মীকেই দেখেছেন গুলিবিদ্ধ হতে। তাই তিনি এখন অনেকটাই বুঝতে পারেন কোন আঘাতটি বেশি মারাত্মক, কোনটি কম। যখন তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে শুয়ে ছিলেন তিনি বুঝতে পারছিলেন তার মৃত্যু সমাগত। খুব শীঘ্রই তিনি ফটো সাংবাদিক মেরি কলভিন এবং জেমস ফলের পথ অনুসরণ করতে যাচ্ছেন। এ দু’জনও সিরিয়ান যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন।
সিরিয়ার নাগরিক হোসেম কাতানের কাহিনী অবশ্য অন্য দু’জনের থেকে খানিকটা আলাদা। আলাদা কারণ, তিনি সে যাত্রাই বেঁচে গিয়েছিলেন এবং তিনি অন্য দু’জনের মত বিদেশী ছিলেন না। তিনি সিরিয়ার অধিবাসী। সিরিয়ান হবার কারণে তার কাজ অন্য বিদেশী সাংবাদিকদের থেকে অনেক বেশি বিপজ্জনক ছিল। যুদ্ধাবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট করতে গেলে, একজন বিদেশি সংবাদদাতা অল্প সময়ের জন্য প্লেনে করে উড়ে এসে রিপোর্ট করেই আবার ফিরে যেতে পারে। কিন্তু হোসেম কাতানের মতো যারা স্বদেশী এবং যুদ্ধের পুরো সময়টাই সে এলাকায় উপস্থিত, তাদের জীবনের ঝুঁকি অনেক বেশি। বলতে গেলে, পালানোর তেমন কোন পথই খোলা থাকে না তাদের জন্য। এরকম সিরিয়ান সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেরই অভিজ্ঞতা খুব কম থাকলেও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোতে যুদ্ধাবস্থা তুলে ধরার জন্য এদের কোন বিকল্প নেই।
এরকম সিরিয়ান সাংবাদিকদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ ছিলেন হোসেম কাতান।
ছোটবেলায় তিনি কখনো কল্পনাও করেননি তিনি একজন যুদ্ধের ফটোগ্রাফার হবেন। ২০১১ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদের বিরুদ্ধে যখন আলেপ্পোতে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি মাত্র ১৭ বছরের একজন ছাত্র ছিলেন। তার বাবা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতেন, যার মজুরি ছিল খুব কম। সেই মজুরিতে তাদের ৮ জনের পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা হতোনা। তাই, হোসেম কাতান সেসময় যারা সরকারি মন্ত্রনালয়ে কোন কাজে যেত তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করতেন। মানে একধরণের দালালি আরকি। সে কাজ করতে যেয়েই তিনি সরকারী আমলাদের মধ্যে ঘুষ আর দুর্নীতির চরম চিত্রের সাথে পরিচিত হন। যখন সে দেখে এই ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য হাজার হাজার সিরীয়ান নাগরিক রাস্তায় নেমে এসেছে তিনিও তাদের সাথে যোগ দেন।
আলেপ্পোর পুলিশ আন্দোলনরত উত্তেজিত জনতাকে বিক্ষিপ্ত করার জন্য তাদের ওপর হামলা চালায় ও আগুন জ্বালিয়ে দেয়। কাতান সে চিত্র তার মোবাইলে ধারণ করেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেন। এরপর তার মোবাইলটি মোজার মধ্যে লুকিয়ে রাখেন যাতে ধরা পরে গেলে এ অপরাধে তার মৃত্যুদন্ড না হয়্। একসময় যখন পুলিশের হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে এবং রাত-বিরেতে তাদের বাড়িতে হামলা চালানো হয় তখন কাতান বিদ্রোহীদের গ্রামগুলোর দিকে পালিয়ে যায়। ২০১২সালের আগস্টের দিকে বিদ্রোহীরা আলেপ্পোর কিছু অংশ দখল করে নেয়। ফলে কাতান সে সময় সিরিয়ায় ফিরে আসেন এবং আলেপ্পোর মিডিয়া সেন্টারে কাজ করা শুরু করেন। এই মিডিয়া সেন্টারে, একদল সংবাদকর্মী সেখানকার সংঘাতের চিত্র লিবিবদ্ধ করে সেগুলো বিদেশী সাংবাদিকদের সহায়তায় বিশ্ববাসীদের কাছে তুলে ধরছিল।
একজন আন্তর্জাতিক ফটো সাংবাদিককে দেখে কাতান ফটো সাংবাদিকতার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন সেসময়। তিনি তার কাছে প্রশ্ন করে লাইট, আঙ্গেল এবং লেন্স সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেন। এরপর তিনি ঘরে ফিরে বহুদিন পর তার ল্যাপটপ নিয়ে বসেন ফটোসাংবাদিকতার খুঁটিনাটি জানতে।
ইসলামিক স্টেটস্ একসময় সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকা দখল করে নেয় এবং বিদেশী সাংবাদিকদের অপহরণ করতে থাকে। সিরিয়ান সাংবাদিকদের জন্য আরও কঠিন সময় দেখা দেয়। আগ্রহী সাংবাদিকরা নিজেরাই হয়ে ওঠে এক একটি সংবাদের উৎস। তারা নিজেরা যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে খবর সংগ্রহ করত এবং তা সামাজিক মাধ্যমে সেগুলো পোস্ট করত।
তারা কেউই বিপদমুক্ত ছিল না। ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টি’-এর তথ্য মতে, ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় ১১০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয় যাদের বেশিরভাগই ছিল সিরিয়ার নাগরিক। তাদের মধ্যে একজন ১৮ বছর বয়সী মলেম বরকত, কাতানের বন্ধু, সংবাদ সংস্থা রইটার্সের একটা এসাইনমেন্টের সময় ট্যাঙ্ক বিস্ফোরনে নিহত হন। বরকত মৃত্যুর পূর্বেই তার ক্যামেরাটা কাতানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল্। কারণ, বরকতের অফিস থেকে তাকে আরেকটি ক্যামেরা দেয়া হয়েছিল কাজ করার জন্য। বরকতের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার হিসেবে তার ক্যামেরা এবং কাজ দু’ই কাতানের হাতে এসে পরে। কাতান রয়টার্সের হয়ে প্রথম অ্যাসাইনমেন্টটার দায়িত্ব পান বরকতের মৃত্যুর দুই দিন বাদে।
২০১৫ সালের মে মাসে বিদ্রোহীরা সরকারের কাছ থেকে একটি এলাকা দখল করার পর কাতান তাদের সাথে ছিলেন। বন্দুকের গুলি এড়িয়ে চলার জন্য বিদ্রোহীরা গাড়িতে না উঠে পায়ে হেঁটে পথ চলছিল। তখন একজন কমান্ডার তাদের বলেছিল, তাদের বামপাশে একজন স্নাইপার আছে তাই সামনের দিকে ঝুঁকে তাদের জোড়ে দৌড় দিতে হবে। কেননা, স্নাইপাররা ঘনঘন গুলি করতে পারে না।
কাতান দেখলেন যে ১০জন লোক দৌড়ে সামনে চলে গেল। তাদের দিকে কাতান জোড়ে দৌড় দিলেন। পর পর দু’টো বুলেট তার সামনে মাটিতে আঘাত করল। কিন্তু তৃতীয় বুলেটটা আঘাত করল তার তলপেটে। কাতান চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। বুঝতে পারলেন না কোথায় গুলিটা আঘাত হেনেছে বা আর কতক্ষণ তার আয়ু আছে। তিনি শরীরে মোচড় দিয়ে তার ফ্লেক জ্যাকেটটা খুলে ফেললেন, শা্র্টের বোতাম খুললেন এবং ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে একটা গভীর শ্বাস নিলেন। একজন তরুণ ফটোগ্রাফারের মতই তিনিও তার ক্যামেরাটি ধরে রাখলেন সহজাতভাবেই। তিনি হামাগুড়ি দিয়ে পিছু ফিরতে লাগলেন।
একজন যোদ্ধা তাকে ধরে স্নাইপারের দিকে ঠেলে দেবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কাতান তাকে ধাক্কা দিয়ে হাতের তালুতে ক্ষতস্থান চেপে দৌড়াতে শুরু করলেন। দৌড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পরতে লাগলেন এবং আবার উঠে সে অবস্থায়ই দৌড়ানো শুরু করলেন। কাতান বলেন, “আমি সেখানে মারা যেতে চাই নি। যদি মারা যাই, তবে ক্যামেরা আমার কোন কাজে লাগবে না।”
পরের কয়েক মাসে তিনি দক্ষিণ তুরস্কের একটি আপার্টমেন্টে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন, যেখানে তার পরিবার পালিয়ে এসে বসবাস করছিল। কিন্তু তখনো কাতান দুনিয়ার সব থেকে বিপজ্জনক শহরটির সাধারণ মানুষদের প্রতিদিনের সংগ্রাম তার ক্যামেরায় বন্দী করতে চাইতেন। যে শহরটি তিনি জীবন বাঁচানোর তাগিদে ছেড়ে এসেছিলেন তার জন্য কিছু করতে চাইতেন। তাই জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি আবার আলেপ্পোতে ফিরে গিয়েছিলেন সে বছরেরই সেপ্টেম্বরে। যেখানে তিনি গুলিবিদ্ধ হযেছিলেন সেই জায়গাটিতেও যান তিনি নিজের মধ্যে থাকা ভয় দূর করতে। আলেপ্পোতে সেসময় তিনি দেখেন তার মত অনেক সিরিয়ানই দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিল। তারা রিফিউজি হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
কাতানও আলেপ্পোতে ফেরার দু’মাস পরেই আবার ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। যদিও নিজের দেশ ছেড়ে যেতে তার বুক ভেঙে যাচ্ছিল্ তবু কাতান ইউরোপে পাড়ি জমাতে চান ফটোগ্রাফি শেখার জন্য। যাতে তিনি তার দেশের দূর্দশার চিত্র আরো ভালভাবে ক্যামেরায় তুলে আনতে পারেন এবং বিশ্ববাসীর কাছে তা তুলে ধরতে পারেন।
২০১৫ সালের নভেম্বরের এক বিকেলে অন্য আরও ৬০ জন সিরিয়ানের সাথে তিনি একটি ডিঙ্গি নৌকায় চেপে বসেন। নৌকাটি তুর্কি হয়ে গ্রীসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। সেখানে পৌঁছার পর আইনশৃঙ্খলা বাহীনির হাতে বন্দী হন কাতান এবং এক সপ্তাহ যাবত এ জেল থেকে সে জেলে ঘুরতে থাকেন শুধুমাত্র তিনি সিরিয়ান পাসপোর্টধারী হওয়ার কারণে। তিনি জেল থেকে মুক্ত হয়ে জার্মানীতে যান। বাসে, ট্রেনে, আবার কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে বহুকষ্টে তিনি একসময় জার্মানীতে পৌঁছান।
শেষ পর্যন্ত এত কষ্ট সফল হয়েছে কাতানের। বর্তমানে তিনি জার্মানির হ্যানোভার ইউনিভার্সিটিতে ফটোজার্নালিজমে পড়াশোনা করছেন। তিনি যদিও এখন তার শহর আলেপ্পো থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বাস করছেন তবু সেখানকার মানুষের দু্র্ভোগ তাকে খুব পোড়ায়। তার লেখা বই, “ইয়ালা হাবিবি” খুব অল্প দিনেই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। সেখানে তিনি আলেপ্পোর পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের প্রতিদিনের যুদ্ধ আর দুর্ভাগ্যের চিত্র তুলে ধরেছেন।
হোসেম কাতান তার বর্তমান অবস্থার কথা বলতে গিয়ে বলেন, “আমার অতীতের অভিজ্ঞতা আমার চিন্তা, জীবনযাত্রা এবং স্বপ্নের পথে পরিবর্তন এনেছে। এখন আমি জানি, খাদ্য আর বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা ই শুধু জীবন নয়, জীবন হলো লক্ষ্যে দিকে এগিয়ে যাওয়া। আর আমার জীবনের লক্ষ্য হলো ফটোজার্নালিজম।”
বাংলাদেশ সময়: ১২১৪ ঘণ্টা, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ