না, কোনো ঝকঝকে চেহারার মডেল নন তিনি। মিডিয়ার আলোতে তাকে দেখা যায় কমই, কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডটি প্রচন্ড জনপ্রিয় ভারতের নারীদের মাঝে। আকর্ষণীয় চেহারার মডেল ছাড়াই ভারতের প্রতিটি রান্নাঘরে সমাদৃত তার মশলার ব্র্যান্ড এমডিএইচ (MDH)। আর এই ব্র্যান্ডের পেছনের মানুষটি হলেন ভারতের সর্বাধিক বেতনভুক্ত কনজুমার প্রডাক্ট সিইও, ৯৪ বছর বয়সী ধরমপাল গুলাটি, যার বিগত অর্থ বছরের বেতন ছিল ২১ কোটি রুপী! হ্যাঁ, মাত্র ১৫০০ রুপী অবলম্বন করে জীবন শুরু করা এই মানুষটির এমডিএইচ (MDH)-এর সাবেক অর্থ বছরে স্যালারি হয়েছে ২১ কোটি। এই অসাধারণ মানুষটির সাফল্যের পেছনে আছে অনুপ্রেরণার এক অসাধারণ গল্প।
পাকিস্তানের শিয়ালকোটে ১৯২৩ সালে জন্ম নেওয়া ধরমপাল ১০ বছর বয়সেই পড়াশোনা ছেড়ে দেন অর্থাভাবে। এরপর তিনি যোগ দেন পৈতৃক মশলার ব্যবসায়। অন্যান্য ব্যবসাতেও নিজের ভাগ্য যাচাই করে দেখতে চান তিনি, সাবানের ব্যবসা, কাপড়ের ব্যবসা এমনকি চালের ব্যবসাও করেছেন এক সময়ে। কিন্তু খুব বেশি সময় ধরে কোনো ব্যবসা ধরে রাখতে পারেননি। একটা সময়ে বাবা চুনি লালের ব্যবসার হাল ধরেন আবার। যখনই একটু থিতু হতে শুরু করলেন, তখনই দেখা যায় বিপর্যয়।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ হবার পর তিনি জানতে পারেন শিয়ালকোট হবে পাকিস্তানের অংশ, তখন তিনি পাকিস্তান ছেড়ে ইন্ডিয়া চলে আসেন। অমৃতসর রিফিউজি ক্যাম্পে কিছুদিন থেকে এসে পড়েন দিল্লী। বাবার কাছে থেকে পাওয়া ১,৫০০ টাকা ছিল তার সম্বল। এর কিছুটা খরচ করে একটা টাঙ্গা (ঘোড়ায় টানা গাড়ি) কেনেন এবং তা চালিয়ে কিছু উপার্জন শুরু করেন।
প্রচন্ড দারিদ্র্যের সে সময়ে সারাদিনেও আরোহী পেতেন না মাঝে মাঝে। একটি সময়ে নিজের এই দারিদ্র্যের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি টাঙ্গা বিক্রি করে দেন, এবং নিজের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে শুরু করেন মশলার ব্যবসা। এর জন্য ছোট একটা কাঠের দোকান দেন তিনি। পিতার থেকে শেখা মশলা তৈরির ম্যাজিককে কাজে লাগিয়ে তিনি মাহাশিয়া দি হাট্টি (MDH) নামে ছোট্ট ব্যবসা শুরু করেন,। কিছুদিনের মাঝেই তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দারিদ্র্য নিয়ে চিন্তার দিন শেষ হয়ে আসে তার। ১৯৫৩ সালে তিনি নিজের দ্বিতীয় দোকান খোলেন চাঁদনী চকে এবং তার লাভের পরিমাণ আরো বাড়তে থাকে। ছয় বছর পর তিনি নিজের মশলা তৈরির জন্য আলাদা কারখানা খোলেন কৃতিনগরে। সারা ভারতে যেন মশলা সরবরাহ করা যায় সেই চিন্তা ছিল তার।
পণ্য
টানা ৬০ বছর শ্রম দেবার পর তার ফলাফল পাওয়া শুরু করেন তিনি। বর্তমানে এই ব্র্যান্ডের ৬০টিরও বেশি পণ্য ১০০টিরও বেশি দেশে জনপ্রিয়। তাদের অফিস আছে দুবাই এবং লন্ডনে। তার এই শ্রমের ফলাফল হিসেবে বর্তমানে ধরমপাল গুলাটির বার্ষিক আয় বর্তমানে ২১ কোটি। এই আয়ের ৯০ শতাংশই তিনি মানবকল্যাণে ব্যয় করেন বলে জানা যায়। MDH কোম্পানির ছত্রছায়ায় চলে ২০টিরও বেশি স্কুল এবং একটি হাসপাতাল।
গুলাটি, যাকে দাদাজি অথবা মহাশয়জি বলেও ডাকা হয়, তিনি নিজে প্রতিদিন ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করেন, মার্কেট এবং ডিলারদের খোঁজ নেন যতক্ষণ না সবকিছু ঠিক আছে বলে তার মনে হয়। এই কাজটি তিনি করে সপ্তাহের সাত দিনই। এই কোম্পানির ৮০% শেয়ার তার নিজের। বর্তমানে তার পুত্র কোম্পানির সার্বিক কর্মকাণ্ডের খেয়াল রাখেন, আর তার ছয় কন্যা বিভিন্ন রাজ্যে পণ্য সরবরাহের ব্যাপারটা দেখভাল করেন। একটি মজার তথ্য হলো, তার স্ত্রীর নাম “সৌভাগ্য”!
কোম্পানির সাফল্যের মুলে রয়েছে তাদের সাপ্লাই চেইন। কৃষকদের সাথে চুক্তি করে তো তারা মশলার উপাদান উৎপাদন করান, এর পাশাপাশি কর্নাটক, রাজস্থা, আফগানিস্থান এবং ইরান থেকেও তাদের মশলা আসে। ইদানিং এই লাভজনক ব্যবসার ক্ষেত্রে MDH এর কিছু প্রতিপক্ষ দেখা যাচ্ছে।
এভারেস্ট ব্র্যান্ডের এস নরেন্দ্রকুমার, হলো বর্তমানের মার্কেট লিডার, তার শেয়ার ১৩ শতাংশ এবং MDH এর ১২ শতাংশ।
তার এই সাফল্যের মূলমন্ত্র কী? তিনি বিশ্বাস করেন, নিজের সেরা কাজটি করলে ফলাফল হিসেবেও আপনি সেরাটাই পাবেন। বছরের পর বছর ধরে তিনি ভালো মানের পণ্য সরবরাহ করে গেছেন সাশ্রয়ী মূল্যে। পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া সত্ত্বেও তাই তিনি এখন একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। সূত্র: ইকোনোমিক টাইমস, কেনফলিয়স, স্টারস আনফলডেড
বাংলাদেশ সময় : ১৬৪০ ঘণ্টা, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭,
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এ