এত দাবি এত দিন কোথায় ছিল

ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ দেখল এক নতুনত্ব। পচে যাওয়া সংস্কৃতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শহরের দেয়ালে দেয়ালে রংতুলি দিয়ে রাঙিয়ে তাক লাগিয়ে দিতে লাগলেন। শহরের ময়লা–আর্বজনা ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে নতুনভাবে নির্মাণের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন। সুশৃঙ্খলভাবে রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও শিক্ষার্থীদের নিরলস পরিশ্রম। সাত দিন পুলিশবিহীন শহরে কিংবা গ্রামে অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেন। এমন একটি দেশের জন্য আগামী প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে, যেখানে কোনোরকমের বৈষম্য থাকবে না। দুর্নীতি, অরাজকতা, এক কেন্দ্রীভূত মনোভাব বিলুপ্ত হবে। ছাত্রনেতার দৌড়ঝাঁপ। হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের খোঁজখবর নেওয়া। রাষ্ট্র বিনির্মাণে উপদেষ্টার অক্লান্ত প্রচেষ্টা। সবই গণ–অভ্যুত্থানের ফসল। আমাদের সৌভাগ্য, একজন নোবেলজয়ী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নিয়োজিত। তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তারুণ্যের এই নতুন বাংলাদেশ নতুন দিগন্তের পথ পাড়ি দেবে, এটাই প্রত্যাশা।

আশা-ভরসা, ধৈর্য নিয়ে আমরা অনেক সময়ে অনেক দিনের অপেক্ষায় আমাদের স্বপ্নের দিকে চেয়ে থাকি। যখন নিরাশ হই, তখন আমরা এমনভাবে খেপে-জ্বলে উঠি, যা হয়ে যায় রীতিমতো বিপ্লব। নিশ্চয়ই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন আসবে। এর মধ্যে কিছু মানুষের উচ্ছ্বসিত টইটম্বুর আবেগে এই বিপ্লবকে অসুন্দর করে তুলবে। এ জন্য আমাদের খুব সর্তকতার সঙ্গে থামতে শিখতে হবে। বিজয় এনেছি বলেই বিজয়ের বাহদুরি দেখাব, এই স্বৈরতন্ত্রী মনোভাব কখনোই সঠিক পথে নিয়ে যাবে না।

স্বৈরশাসককে বিতাড়িত করে নতুন একটি সরকার এসেছে, যা গতানুগতিক রাজনীতির সরকার নয়। রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে উপদেষ্টারা জড়িতও নন। তবে নতুন এই বাংলাদেশ পেয়েছে সেরা ব্যক্তিদের। তাঁরা নিজ নিজ জায়গায় বিচক্ষণ, খ্যাতিমান। আমরা এই খ্যাতিমান রাষ্ট্র পরিচালকদের একটু সময় দিই। একটু সুস্থ মস্তিষ্কের চিন্তার জন্য একটা পরিবেশ সৃষ্টি করি। তা না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ আমরাই বিনষ্ট করব।

বেশ কয় দিন ধরে নিজের কাছে অস্থির লাগছে। প্রথমে ভাঙচুর, লুটপাট, মানুষের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচারণ; এটা থামতে না থামতে রাজপথে আরেক বিপ্লব। এই বিপ্লব হলো নানা রকমের দাবি। পুলিশের দাবি, সরকারি কর্মকারীর দাবি, শ্রমিকের দাবি, শিক্ষার্থীদের দাবি, মেট্রোরেল শ্রমিকের দাবি—এমনকি সিকিউরিটি ইনচার্জ পরিবর্তনের জন্য দাবি। ঢাকা শহর যেন এক দাবির শহরের রুপান্তরিত হয়েছে।

রাস্তাঘাট থামিয়ে, মানুষের দুর্ভোগ্য বাড়িয়ে এই ‘দাবি’র মিছিল যেন নতুন বাংলাদেশকে দাবিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। আমার প্রশ্ন, এত দিন এত দাবি কোথায় ছিল?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবদুল মান্নান এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছেন, ‘দাবিগুলো দাবিয়ে রাখা হয়েছিল মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে।’ রোকনুজ্জামান রুকুর মন্তব্য, ‘আগে দাবি করলে অস্তিত্ব থাকত? আপনিও তো লেখক, স্বাধীনভাবে লিখতে পারছিলেন?’ প্রকাশক সৈয়দ জাকি হোসেনের মন্তব্য, ‘ধারালো ছুরি যেকোনো জায়গায় ব্যবহার করতে নেই, এখন সবাই নানাভাবে জমিয়ে রাখা ছুরি, নতুন ধারালো ছুরি বের করছে, উদ্দেশ্য বুঝতে হবে।’ আবার উদ্যোক্তা তাহমিনা শৈলী লিখেছেন, ‘দাবি সব সময়ই ছিল। দাবি করলে আগে প্রাণ দিতে হতো বা আজীবনের জন্য অচল হতো জীবন।’ সংগঠক মাহবুব শাকিল বলছেন, ‘এত দিন ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি, আন্দোলন করবে কী?’ এর প্রত্যুত্তরে আবার সায়মা আহসান বলেছেন, ‘তার মানে স্বীকার করলা তাহলে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কথা বলার স্বাধীনতা ‘স’ও মানুষের ছিল না। ধন্যবাদ।’

এত সব দাবি আদায়ের ভিড়ে শিক্ষার্থীদের এইচএসসির স্থগিত পরীক্ষাগুলো না দেওয়ার দাবিটুকু কি যৌক্তিক?

Scroll to Top