গণমিছিলে সংঘর্ষে পুলিশসহ নিহত ২

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা কর্মসূচি কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ফের উত্তাল সারা দেশ। গতকাল ঢাকার উত্তরায় ত্রিমুখী সংঘর্ষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। হাই কোর্টের সামনে বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সাঁজোয়া যান ভাঙচুর করেন। খুলনায় বিক্ষোভকারীরা একটি পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। এ সময় সংঘর্ষে একজন পুলিশ নিহত হন। হবিগঞ্জে পুলিশ-বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে একজন শ্রমিক মারা গেছেন। হামলা চালানো হয় অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহির এমপির বাসভবনে। চট্টগ্রামে বিক্ষোভকারীরা পুলিশ বক্সে ভাঙচুর করেন। সিলেটে একজন সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হন। সংঘর্ষের এসব ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশে দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, রাজবাড়ী, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, পাবনা, লালমনিরহাট ও ভোলায় গণমিছিল হয়েছে। ঢাকায় আন্দোলন কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করে গণমিছিল করেছে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন।

গণমিছিল কর্মসূচি কেন্দ্র করে ঢাকার উত্তরা ছিল রণক্ষেত্র। বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে এলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে এক শিক্ষার্থীসহ দুজন গুলিবিদ্ধ এবং অনেকে আহত হয়েছেন। বিকালে উত্তরার জমজম টাওয়ারের মোড় ও ১১ নম্বর সেক্টর মাইলস্টোনের সামনে গণমিছিলের সময় এ সংঘর্ষ হয়। এতে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর রোডে অবস্থিত ভুবন লন্ড্রি হাউসের মালিক দুলাল হাওলাদার এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী তাহমিদ হুজাইফা গুলিবিদ্ধ হন। তাদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক এবং বিভিন্ন সড়ক ও মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আনসার মোতায়েন করা হয়। সকাল থেকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা অবস্থান কর্মসূচি ও সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেন।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা গণমিছিল কর্মসূচি সামনে রেখে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকরা উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের জমজম টাওয়ারের সামনে অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীরা মাইলস্টোন কলেজের সামনে অবস্থান নেন। তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। একপর্যায়ে পুলিশ, শিক্ষার্থী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করলে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। শিক্ষার্থীরা সেক্টরের বিভিন্ন সড়কে ছড়িয়ে পড়েন। পরে আবার শিক্ষার্থীরা প্রধান সড়কে ওঠার চেষ্টা করেন। তখন আবার তাদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় শিক্ষার্থীরা আবার ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
সকাল থেকেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছাত্রদের ওপর গুলি করা বন্ধের প্রতিবাদে ‘ওয়ান্টস ফর জাস্টিস’ ইস্যুতে রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা কলেজের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে অবস্থান নেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের অনেকেই পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম ছিল। দুই ঘণ্টাব্যাপী এই বিক্ষোভের কারণে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

জুমার নামাজ শেষে উত্তরার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের দুই শতাধিক ছাত্রছাত্রী উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টর রাজউক মডেল কলেজ এলাকায় বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন। ধীরে ধীরে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজন ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেওয়া শুরু করলে সড়কে টহলরত সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা মিছিলে বাধা দেন। এ সময় পুলিশ মিছিলকারী ছাত্র নেতাদের কয়েকজনকে ডেকে এনে ছাত্রদের নিয়ে চলে যেতে বলে। ছাত্ররা পুলিশের বাধার মুখে মিছিল নিয়ে উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টর এলাকা দিয়ে হাউস বিল্ডিংয়ের দিকে চলে যান।

একই সময়ে সায়েন্সল্যাব মোড় অবরোধ করেন ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফ কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজসহ আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বিকাল ৪টার পর মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। একই সময় ঢাকার ইসিবি চত্বরে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক শ শিক্ষার্থী। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আন্দোলন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিষদ এবং কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা দ্রুত ৯ দফা দাবি বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। পরে তারা প্রেস ক্লাব ছেড়ে হাই কোর্টের সামনে দিয়ে শাহবাগের দিকে চলে যান। অন্যদিকে বায়তুল মোকাররম মসজিদে জুমার নামাজ শেষে গণমিছিল শুরু করেন কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। মিছিলে ভুয়া ভুয়া বলে স্লোগান দিতে দেখা যায় তাদের। মিছিলটি বায়তুল মোকাররম থেকে পল্টনের দিকে যেতে থাকে। পরে শাহবাগ পৌঁছালে মিছিলটি আটকে দেয় পুলিশ। এর আগে হাই কোর্টের সামনে পুলিশের একটি সাঁজোয়া যানে হামলা চালানো হয়।

জাতীয় প্রেস ক্লাবে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সাংস্কৃতিক শিল্পীগোষ্ঠী উদীচী। এতে সংহতি জানিয়ে অংশ নেয় বেশ কয়েকটি সংগঠন। সমাবেশ শেষে ‘দ্রোহযাত্রা’ শিরোনামে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের ব্যানারে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ কয়েক হাজার মানুষ এতে অংশ নেন। পরে সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর ও টিএসসি হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা ‘কী দরকার ছিল এই অন্ধের শহরে চশমা বিক্রি করার?’, ‘লাশের হিসাব করি নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘কত বুলেট আছে গুলি কর’, ‘আমরা অনেক দিন হাসি না’ ইত্যাদি পোস্টার ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ করেন মেডিকেল শিক্ষার্থী ও চিকিৎসকরা।

Scroll to Top