তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা, যা যা ঘটতে পারে!

একদিকে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার আবহ। অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়া বনাম আমেরিকা-দক্ষিণ কোরিয়া জোট। তারপর রয়েছে নতুন করে লাদখ সীমান্তে ভারত-চীন উত্তেজনা।

ইরান-ইসরায়েল আশঙ্কাও কোনও অংশে কমেনি। নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে আমেরিকা-তুরস্ক অশান্তিও। আর সবকিছুর ওপরে বিশ্বকে ভাবাচ্ছে মার্কিন-চীন সম্পর্কের অবনতিও। এই সব মিলিয়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল দুটি শব্দ- তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নেটপাড়ার বক্তব্য, ২০২০-২১ এই সূচনা হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের। অশনি সংকেত যে নেই, তা বলা যাবে না। তবে অধুনা দেশগুলোর শক্তির বিচার করলে বিশ্বযুদ্ধ কি সত্যিই সম্ভব? তুলে ধরা হল বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতির সঠিক পর্যালোচনা:-

অতীতের ভবিষ্যৎ বাণী!
ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েই বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করবেন। এমনই চাঞ্চল্যকর ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন ক্লেয়ারভয়ান্ট হোরাসিও ভিলেগাস নামেক এক স্বঘোষিত ভবিষ্যৎ বক্তা।

ভিলেগাসের দাবি ছিল, সিরিয়ার রাসায়নিক হামলা নিয়ে ক্ষমতাশালী দেশগুলো লড়াইয়ে মাতবে। সেই লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়বে রাশিয়া, চীন এবং উত্তর কোরিয়া। এই যুদ্ধে ভয়ঙ্কর ক্ষতি এবং প্রচুর মানুষের মৃত্যু হবে। হোরাসিওর বার্তা অনুযায়ীই সিরিয়াকে কেন্দ্র করে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে চাপানউতোর চলছিল ঠিকই। একই সময়ে আমেরিকাকে পরমাণু হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উনও। তবে টানাপোড়েনের আবহ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয়নি। তবে বিশ্ব থেকে মুছে যায়নি যুদ্ধ-পরিস্থিতি। বরং বিশ্বের বিভিন্ন অংশে, রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চলতে থাকা চাপা উত্তেজনা ক্রমশই বাড়ছে।

ভারত-চীন
ডোকলাম সংকটে ইঙ্গিত মিলেছিল। চলতি বছরে পূর্ব লাদাখের গলওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চীনা বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর বাস্তবেই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল দুই প্রতিবেশির মধ্যে। পৃথিবীর কঠিনতম রণক্ষেত্রের মধ্যে অন্যতম ভারত-চীনের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর সেনা সমাবেশ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল দুইদেশই। যার জেরে দুইদেশের সামরিক শক্তির তুলনা বা পরিস্থিতির বিভিন্ন ধরনের বিচার শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন মাধ্যমে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মধ্য এশিয়াতে মার্কিন উপস্থিতি চীনের আশঙ্কার বড় কারণ। আর সেই সঙ্গে ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যত বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক হচ্ছে, ততই ভারত সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠছে বেইজিং। যার মূল কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের শক্তিবৃদ্ধিতে প্রধান বাধা ভারতই। আর এই কারণেই ধীরে ধীরে ভারতীয় সীমান্তে রণকৌশলে গুরুত্ব দিয়েছে চীন। প্রতিবেশি এই দেশের আস্ফালনের প্রতিফলন স্বরূপ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করেছে নয়াদিল্লিও।

এদিকে, দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের সম্পর্কের ছায়া পড়েছে অন্য প্রতিবেশিদের ওপরও, যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে নেপালের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্বে। চীন সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং সম্প্রতি ভুটানের সঙ্গেও।

ভারত-পাকিস্তান (কাশ্মীর)
গত ১০ বছরে ক্রমশই খারাপ হয়েছে ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতার পরবর্তী থেকেই অশান্তি LoC-তে। প্রতিবেশি এই দেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে সীমান্ত সন্ত্রাসের অভিযোগে সরব নয়াদিল্লি। পাকিস্তানের ভূমিকে ব্যবহার করে বিশ্বে যেভাবে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ছে, তা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরেছে ভারত। উরিতে জঙ্গি হামলার পর পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালায় ভারতীয় সেনা। যার জেরে দুইদেশের সম্পর্ক আরও তলানিতে পৌঁছায়। ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ গঠন করে মোদী সরকার। যার তীব্র প্রতিবাদ আসে ইসলামাবাদ থেকে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতেও ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতির জেরে যুদ্ধের আশঙ্কা থাকবে।

ইরান-ইসরায়েল
গাজা, সিরিয়া এবং লেবানেন ইসরায়েল বিরোধী গোষ্ঠীদেরকে সরাসরি সমর্থনের অভিযোগ ইরানের বিরুদ্ধে। যার জেরে ইরান-ইসরায়েল সহিংসতা কমার কোনও লক্ষণ দেখতে পারছেন না আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। ইরানবিরোধী কূটনৈতিক পদক্ষেপের পাশাপাশি একাধিকবার সীমান্তে ইরানের সেনাকে লক্ষ্য করে হামলায় জড়িয়েছে জেরুজালেম। ইরানকে সবচেয়ে ‘বিপজ্জনক রাষ্ট্র’ও ঘোষণা করেছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার। ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকাকেও পাশে পেয়েছে ইসরায়েল।

ইরান-আমেরিকা
পরমাণু নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত। সেখান থেকে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পশ্চিম এশিয়া থেকে ‘আমেরিকার অস্তিত্ব মুছে’ ফেলার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান। ২০২০ সালের শুরুতেই সংঘর্ষে জড়িয়েছে আমেরিকা-ইরান। জানুয়ারিতে ইরাকের বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে মার্কিন ড্রোন হামলায় মৃত্যু হয় ইরানের শীর্ষ সেনাকর্মকর্তা জেনারেল কাসেম সোলাইমানির। প্রাণ হারান ইরাকের পার্লামেন্টারি বাহিনীর ডেপুটি চিফ আবু মেহদি অল মুহান্দিসও। সোলাইমানির হত্যার প্রতিশোধ নিতে মধ্যরাতে ইরাকের মার্কিন সেনা ও যৌথ বাহিনীর ব্যবহৃত দুটি ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র চালায় তেহরান। তাতে কমপক্ষে ৮০ জন মার্কিন সেনা নিহত হয়েছে বলে দাবি করেন ইরানের শীর্ষনেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। এর ফল যে ‘ভালো হবে না’, ইরানকে সেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

আমেরিকা-উত্তর কোরিয়া
সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়ার শক্তি প্রদর্শন ও পরমাণু অস্ত্রের চোখরাঙানি ভয় ধরিয়েছে বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে। এই দ্বীপরাষ্ট্রের খবর বাইরের দুনিয়ায় খুব বেশি না এলেও কিম জং উনের রাজত্বে প্রচণ্ড গতিতে শক্তিবৃদ্ধি করেছে পিয়ংইয়ং। সামরিক শক্তিতে বিশ্বের তাবড় দেশগুলোকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে তারা। ওয়াশিংটন হুঁশিয়ারি দিলে পালটা পরমাণু অস্ত্রের হুমকি দিয়েছেন কিম। এছাড়াও ক্রমাগত প্রতিবেশি দক্ষিণ কোরিয়ার উপর দাপট দেখানোর চেষ্টা থেকে বিরত হয়নি উত্তর কোরিয়া। এদিকে, সহযোগী দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন সেনা রয়েছে। কিমকে রুখতে ‘সঠিক সময়ে’ ব্যবস্থার কথা জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। শক্তিশালী দুই দেশের মধ্যের পরিস্থিতি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়েছ বটেই।

চীন-আমেরিকা
গোটা দুনিয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বেইজিংয়ের প্রতি লাগাতার উষ্মা প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন। করোনাভাইরাস নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই চীনকে কড়া ভাষায় বিঁধছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনই ‘করোনা সৃষ্টি’ করেছে বলেও বিস্ফোরক অভিযোগ করেছেন।

পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথমে পণ্য শুল্ক নিয়ে চাপানউতোর এবং বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির জের-ক্রমশই ঠাণ্ডা যুদ্ধের কিনারার দিকে যাচ্ছে মার্কিন-চীন সম্পর্ক। করোনা সংক্রমণ, হংকং ইস্যু- দুইদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের পারদ যে ক্রমশই চড়ছে, তা স্বীকার করে মন্তব্য করেছে বেইজিংও। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায়, ‘চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ককে ঠাণ্ডা যুদ্ধের দিকে ঠেলছে আমেরিকা।’ বিপুল শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে সংঘাত বাড়লে তা গোটা বিশ্বের জন্যই অত্যন্ত আশঙ্কার হবে বলেই মত আন্তর্জাতিক মহলের।
: এই সময়

Scroll to Top