করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) বিশ্বের অন্তত ১০০টি বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও এখন পর্যন্ত তিনজনের শরীরে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে এই ভাইরাসে তিন হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আক্রান্ত অবস্থায় আছেন এক লাখেরও বেশি। তবে অনেক গবেষক মনে করছেন, আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ১০ গুণ হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৪৪ হাজার রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৮১ শতাংশের শরীরে হালকা লক্ষণ দেখা দেয়। ১৪ শতাংশের শরীরের লক্ষণ দেখা দেয় এর চেয়ে মাঝারি আকারে। অন্যদিকে মাত্র ৫ শতাংশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১ থেকে ২ শতাংশ মানুষ মারা যায়। যদিও এই হার বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, হাজার হাজার মানুষ এখনো চিকিৎসাধীন, যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মারা যেতে পারেন। তাই মৃতের হার আরও বাড়তে পারে। আবার কত মানুষের শরীরী হালকা লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। সেগুলো বিবেচনায় নিলে মৃতের হার আরও কমতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রতিবছর ১০০ কোটির মতো মানুষ ভাইরাসজনিত ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এর মধ্যে ২ লাখ ৯০ হাজার থেকে সাড়ে ৬ লাখ পর্যন্ত মানুষ মারা যান। প্রতিবছরই এসব ভাইরাসের ভয়াবহতার মাত্রা পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
আক্রান্ত হলে কীভাবে বুঝবেন
করোনাভাইরাস মূলত ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণত জ্বরের সঙ্গে শুকনা কাশি দিয়ে শুরু হয়। জ্বর ও কাশির এক সপ্তাহের মাথায় শ্বাসকষ্ট অনুভূত হয়। এসব লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ প্রকাশ পেতে ১৪ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এটাকে ইনকিউবেশন পিরিয়ড বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ রোগীর লক্ষণ প্রকাশের আগে এই ভাইরাস ব্যক্তির শরীরে এ সময় পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে।
তবে কিছু গবেষকের মতে, এই ইনকিউবেশন পিরিয়ড ২৪ দিন পর্যন্ত হতে পারে। আবার চীনের অনেক বিজ্ঞানী বলছেন, লক্ষণ প্রকাশের আগেও অনেকে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন।
আক্রান্ত হলে কীভাবে বুঝবেন
এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এর টিকা আবিষ্কারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আশা করা হচ্ছে, চলতি বছরের শেষের দিকে এই টিকা মানুষের শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা যাবে।
যেহেতু ভাইরাসটি ফুসফুস ও শ্বাসকষ্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সে হিসেবে বর্তমানে আক্রান্ত ব্যক্তিদের এ–সংক্রান্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা করে রাখা হয়। শ্বাসকষ্ট কমাতে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসকেরা নিজেদের মতো করে ভাইরাস প্রতিরোধী ওষুধ প্রয়োগ করে থাকেন।
কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা পেতে সাবান দিয়ে বারবার হাত ধুতে হবে, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু বা রুমাল দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে ফেলতে হবে, হাঁচি-কাশি দেওয়ার পরপরই হাত ধুয়ে ফেলতে হবে, পারতপক্ষে নাক, মুখ ও চোখে হাতের স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, এতে এ ধরনের ভাইরাস হাত থেকে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। হাঁচি-কাশি বা জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি কি পরিপূর্ণ সুস্থ হতে পারেন?
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হতে পারেন। কারণ, এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেই জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টের মতো সাধারণ সমস্যা অনুভব করে থাকেন। ফলে আশা করা যাচ্ছে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত বেশির ভাগ ব্যক্তিই সুস্থ হয়ে যাবেন।
তবে বয়স্ক, ডায়াবেটিস ও ক্যানসারের মতো রোগী বা যাঁদের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কম, তাঁদের জন্য এই ভাইরাস বিশেষ ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসে চীনে তিন শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের এক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি, যাঁদের রোগের প্রকোপ কম, তাঁদের সুস্থ হতে এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।
করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এই ভাইরাস ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে থাকা পরিবারের সদস্য, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সতর্ক থাকতে হবে।
এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের মতো রোগগুলোর কোনো টিকা নেই। তবে টিকা আবিষ্কারে গবেষকেরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কারণ এ ধরনের ভাইরাস এর আগে দেখা যায়নি। ফলে চিকিৎসকেরা এর আগপর্যন্ত এ ধরনের ভাইরাস সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন।
কত দ্রুত ছড়াচ্ছে কোভিড-১৯
বর্তমানে প্রতিদিন এই ভাইরাসে আক্রান্ত শত শত নতুন রোগীর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এ জন্য অনেক গবেষকই মন্তব্য করছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠানগুলো আক্রান্ত ব্যক্তিদের যে সংখ্যা জানতে পারছে, প্রকৃত সংখ্যা তার থেকে ১০ গুণ বেশি হওয়াও সম্ভব।
চীনের বাইরে এ ভাইরাস সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি ও ইরানে। এখন পর্যন্ত ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, মিয়ানমারসহ বিশ্বের অন্তত ৩৪টি দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে সংক্রমণের উৎপত্তিস্থল চীনের উহানে।
কীভাবে ছড়াল কোভিড-১৯
গত বছরের ডিসেম্বরে শনাক্ত হওয়া এ ভাইরাস চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের ‘সাউথ চায়না সিফুড হোলসেল মার্কেট’ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বলে প্রাথমিক ডেটা বিশ্লেষণে জানা গেছে। ওই বাজারে বাদুড়, বনবিড়াল, সাপের মতো বন্য প্রাণীগুলোও খাওয়ার জন্য জীবন্ত বিক্রি করা হতো। বেশ কয়েকটি গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বাদুড় থেকে মানুষের শরীরে এ ভাইরাস ছড়িয়েছে। অর্থাৎ প্রাণীর কাছাকাছি যাওয়া মানুষের মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়িয়েছে।
করোনাভাইরাসের অপর একটি রূপ হলো সার্সভাইরাস (সেভার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম), যা ২০০২ সালে চীনে ছড়িয়ে পড়ে অন্তত ৭৭৪ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছিলেন। সার্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৯৮ জন। সে হিসাবে কোভিড-১৯ অনেক ভয়াবহভাবে ছড়াচ্ছে। সার্স ভাইরাস বাদুড় থেকে বনবিড়ালে সংক্রমিত হয়েছিল। পরে তা মানবদেহে ছড়িয়ে পড়েছিল।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক খাজা নাজিমুদ্দিনের পরামর্শ:
করোনাভাইরাসের নানা ধরন রয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। বর্তমানে চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনাভাইরাস তেমনই একটি ভাইরাস। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের সংক্রমণের বা কোভিড-১৯ রোগের কোনো টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যক্তিগত সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর লক্ষণ প্রকাশে সর্বোচ্চ ১৪ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। কোভিড-১৯-এর লক্ষণগুলো হলো:
শুকনো কাশির সঙ্গে জ্বর, শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা, মাংসপেশিতে ব্যথা থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংক্রমণ শুরু হয় জ্বর দিয়ে। এরপর শুকনো কাশি হতে পারে, যার এক সপ্তাহের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ঝুঁকিতে যারা
যেকোনো ফ্লু–জাতীয় রোগে আনুষঙ্গিক রোগ যেমন কিডনি, হার্ট বা লিভার ফেইলিউর, আগে থেকেই অসুস্থ বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন ব্যক্তি, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে এবং গর্ভবতী নারীরা ঝুঁকিতে থাকেন বেশি। নতুন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে প্রবীণদের মৃত্যুর হার বেশি। শিশুদেরও ঝুঁকি কম নয়।
সংক্রমণ ঠেকানোর উপায়:
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যক্তিগত সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই
ড্রপলেট ইনফেকশন অর্থাৎ হাঁচি-কাশির মাধ্যমে রোগটি ছড়ায়। আক্রান্ত, সন্দেহজনক আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে না আসাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো প্রতিরোধ। নিজেকে নিরাপদ রাখতে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত যেকোনো ব্যক্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন।
আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিচর্যাকারীর মুখে বিশেষ মাস্ক পরতে হবে। কখনোই নাক-মুখ না ঢেকে হাঁচি-কাশি দেবেন না। ব্যবহৃত টিস্যু বা রুমাল যথাযথ জায়গায় ফেলতে হবে।
বারবার সাবান-পানি বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। যেসব বস্তুতে অনেক মানুষের স্পর্শ লাগে, যেমন সিঁড়ির রেলিং, দরজার নব, পানির কল, কম্পিউটারের মাউস বা ফোন, গাড়ির বা রিকশার হাতল ইত্যাদি ধরলে সঙ্গে সঙ্গে হাত পরিষ্কার করতে হবে। মাছ-মাংস ভালো করে সেদ্ধ করে নিতে হবে।