সাভারে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিহত শিক্ষার্থী নাফিসা হোসেন মারওয়া এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.২৫ এ উত্তীর্ণ হয়েছেন। ১৭ বছর বয়সী এই কিশোরী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে সম্মুখ সারিতে ছিলেন। গত ৫ আগস্ট দুপুরে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিন সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন থানা রোডে পুলিশের গুলিতে মারা যান তিনি।
সেই নাফিসার এইচএসসির ফল প্রকাশিত হয়েছে গতকাল। তিনি গাজীপুরের টঙ্গীর সাহাজউদ্দিন সরকার আদর্শ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪ দশমিক ২৫ পেয়ে পাস করেছেন। তবে তাঁর মায়ের মুখ মলিন। কারণ, যার ফলাফল, সে–ই তো পৃথিবীতে নেই।
নাফিসার মা কুলসুম বেগম বলেন, মেয়ের যাতে লেখাপড়া নষ্ট না হয়, সেই জন্য রান্না করতে দিতাম না। চায়ের দোকান দিয়ে যা দুই টাকা উপার্জন করেছি, মারওয়ার লেখাপড়ায় দিয়েছি। মেয়ে আমাকে না জানিয়ে ১৮ জুলাই থেকে উত্তরায় যেত আন্দোলনে। সারাদিন দোকানে থাকায় খোঁজ পেতাম না। প্রতিবেশীর কাছে জেনে মেয়েকে ঘরে আটকাই রাখি। আন্দোলনে যাওয়া নিয়ে খুব রাগ করেছিলাম। তবে মেয়ে আমাকে ফাঁকি দিয়ে গেছে। ৩ আগস্ট বলল, লেখাপড়া নেই, ঘরে থেকে দমবন্ধ লাগছে। সাভারে মামার বাসায় বেড়াতে যাবে। ভেবেছিলাম, সাভারে গেলে আন্দোলনে যাবে না।
২০২২ সালে নাফিসার মা কুলসুম বেগম পারিবারিক সমস্যার কারণে দুই মেয়েকে নিয়ে সাভারের দক্ষিণ বক্তারপুরে কোর্টবাড়ি এলাকায় চলে আসেন। এরপর তিনি মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিদেশে পাড়ি জমান। নাফিসাকে ভর্তি করা হয় সাভারের বেসরকারি ল্যাবরেটরি কলেজে। গত বছরের শেষের দিকে নাফিসার বাবা আবুল হোসেন নাফিসাকে টঙ্গীতে নিয়ে যান। তিনি নাফিসাকে সাহাজউদ্দিন সরকার আদর্শ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। তবে নাফিসা অধিকাংশ সময়ে সাভারে মামা মো. হযরত আলীর বাসায় থাকতেন। গত ২৮ জুলাই ধামরাইয়ে বড় মামার বাসায় আসেন। পরে ৩০ জুলাই ছোট মামা হযরত আলীর বাসায় যান। এরপর থেকে বন্ধুদের সঙ্গে সাভারে আন্দোলনে অংশ নিতেন।
আগস্টের ৩ তারিখ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের সঙ্গে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন নাফিসা। ৫ আগস্ট সকালে মামাকে জানিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গাবতলীতে যাবেন। ঝামেলার বিষয়টি ভেবে মামা হযরত আলী আন্দোলনে যেতে নিষেধ করছিলেন; কিন্তু নাফিস নিষেধ শোনেননি। কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর মামা নাফিসার মুঠোফোনে কল দিলে জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। তখন মামা তাঁকে রেডিও কলোনি হয়ে বাসায় ফিরতে বলেন। বেলা ১১টার দিকে আবার কল দিলে আর ধরেননি নাফিসা।
বেলা আড়াইটার দিকে নাফিসার ছোট বোন সাফা হোসেন কল দিলে অপরিচিত একজন কল ধরে ‘নাফিসা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন’ জানিয়ে ল্যাবজোন হাসপাতালে যেতে বলেন। বিষয়টি জানতে পেরে হযরত আলী ল্যাবজোন হাসপাতালে যান। সেখানে গিয়ে নাফিসাকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখতে পান। কিছুক্ষণ পর চিকিৎসকেরা নাফিসাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে আন্দোলনকারীরাসহ লাশ বাসায় নেওয়ার পথে মুক্তির মোড় এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ ছররা গুলি ছোড়ে। এতে হযরত আলীসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অ্যাম্বুলেন্সে বিকেল চারটার দিকে লাশ মামার বাসায় নেওয়া হয়।
নাফিসার মা কুলসুম বেগম বলেন, আমার অনেক ইচ্ছা ছিল মেয়েটাকে শিক্ষিত করবো। অনেক কষ্ট করে পড়াশুনাও করাইছি। কিন্তু আমার সেই ইচ্ছা আর পূরণ হইলো না। নিজের রেজাল্টটাও দেখে যেতে পাড়লো না। নাফিসার মৃত্যুর সঙ্গে আমার স্বপ্নও ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে।