লিলি বেগমের বয়স ৬০ ছুঁয়েছে। প্রায় দুই ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে তাঁর বাড়ি। বাড়ির সামনে যে নলকূপটি ছিল, সেখান থেকে তাঁরা সাতটি পরিবার পানি সংগ্রহ করতেন। এখন সেই নলকূপটিও ডুবে গেছে। চারদিকে থই থই পানি হলেও পানযোগ্য পানির তীব্র সংকট। পরিবারের সবাই আশ্রয়কেন্দ্রে এসে উঠলেও দুর্ভোগ কমেনি তাঁদের। আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনা খাবারদাবার মিললেও পানি মিলছে অল্প পরিমাণ। পান করতে হচ্ছে খুব হিসাব করে।
লিলি বেগম বলেন, ঘরে-বাইরে সবখানে শুধু পানি আর পানি। অথচ এক সপ্তাহ ধরে পান করার জন্য বিশুদ্ধ পানির দেখা মিলছে না। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম লতিফপুর এলাকার এই নারীর মতো হাজারো গ্রামবাসী সুপেয় পানির চরম সংকটে পড়েছেন।
লিলি বেগমের গ্রামই কেবল নয়, গোটা লক্ষ্মীপুর জেলা এখন বন্যায় আক্রান্ত। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায়ও যে সড়ক শুকনা ছিল, আজ মঙ্গলবার সকালে সেখানে কোমরসমান পানি। যে ঘরে গতকাল রাতে বাসিন্দারা ঘুমিয়েছেন, সেখানে এখন হাঁটুপানি। এমনিই অবনতির দিকে যাচ্ছে জেলার বন্যা পরিস্থিতি। আজ পানির উচ্চতা আরও বেড়েছে। প্রায় সব এলাকায় ডুবে আছে নলকূপ।
গতকাল সোমবার বিকেলে লিলি বেগমের সঙ্গে কথা হয় লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম লতিফপুরের আলহাজ ইব্রাহিম মিয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে। নিজের দুর্দশার কথা বলতে বলতে তিনি চোখ মোছেন। তিনি বলেন, তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্যের সবাই এখন আশ্রয়কেন্দ্রে এসে উঠেছেন। এখানে খাওয়া, ঘুমানোর কষ্টের চেয়েও বেশি পানির কষ্ট। আশ্রয়কেন্দ্রের নলকূপও ডুবে গেছে। এখানকার স্বেচ্ছাসেবকেরা যে পানি দিচ্ছেন, তাতে সবার পিপাসা মেটে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, নোয়াখালী জেলার বন্যার পানি লক্ষ্মীপুরের লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। জেলার রহমতখালী খাল, ভুলুয়া খাল ও ওয়াপদা খাল হয়ে ব্যাপকভাবে পানি ঢুকছে। বাড়ছে নদী-খালের পনির উচ্চতা। আজ মঙ্গলবার দুপুরেও পানি বাড়ছিল বলে জানিয়েছেন লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান।
নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, নোয়াখালী জেলার বন্যার পানি লক্ষ্মীপুরে ঢুকছে। নোয়াখালীর পানি পুরোপুরি নেমে না যাওয়া পর্যন্ত লক্ষ্মীপুরের পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, এমন দুর্বিষহ অবস্থা ১৯৮৮ সালের বন্যার সময়ও হয়নি। বন্যা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। অব্যাহত ভারী বৃষ্টি ও নোয়াখালী থেকে আসা পানির ঢলে এখন উঁচু সড়কগুলোও ডুবে গেছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলার ৯০ ভাগ এলাকাই এখন পানির নিচে। এতে ৭ লাখ ২৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। ডুবে গেছে, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ফসলি খেত ও বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কোথাও কোথাও চার-পাঁচ ফুট পানি রয়েছে। জেলা সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, রামগতি ও কমলনগর উপজেলার ৫৮টি ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে।
জেলার অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় পানিবন্দী লোকজন এখনো কোনো সহায়তা পাননি। সেসব জায়গায় ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে মানুষ। দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাতে পর্যাপ্ত নৌকার প্রয়োজন হলেও তা মিলছে না। খাবারের পাশাপাশি সব জায়গায়ই এখন তীব্র পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
রামগঞ্জ উপজেলার ভাদুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাবেদ হোসেন ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন জানান, অনেক বাড়িতেই কোমরসমান পানি। মানুষ আতঙ্কে আছে। আপাতত জীবন রক্ষার জন্য মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন। অনেকে ত্রাণের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন লক্ষ্মীপুরের মানুষ। সরকারি ও বেসরকারিভাবে যে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুস মিয়া জানান, জেলায় বর্তমানে ৭ লাখ ২৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ২৭ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। জেলার পাঁচটি উপজেলার ৯০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ইতিমধ্যে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ১৫৫ মেট্রিক টন জিআর চাল ও ১০ লাখ নগদ টাকা (জিআর ক্যাশ) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
৪০ হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে
এদিকে লক্ষ্মীপুরের প্রায় ৪০ হাজার পুকুর ডুবে গেছে। ভেসে গেছে প্রায় সব মাছ। এতে জেলায় মৎস্য খাতে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে ধারণা করছে মৎস্য বিভাগ।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, জেলায় মাছ চাষের প্রায় ৫৪ হাজার পুকুর রয়েছে। এর মধ্যে ৪০ হাজার পুকুর ডুবে ৯০ শতাংশ মাছ ভেসে গেছে। এতে মৎস্যচাষিদের ৮০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।