ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর পেয়ে ৫ আগস্ট দুপুরে মিছিলের সঙ্গে বের হয়েছিলেন গাড়িচালক মো. শাকিল আহমেদ (২৫)। সেদিন বেলা তিনটার দিকে মিছিলে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে। হঠাৎ একটি গুলি এসে শাকিলের শরীরে বিদ্ধ হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
শাকিলের বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের শিরীষগুড়ি গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মো. নাসির উদ্দিনের বড় ছেলে। স্থানীয় এক ব্যক্তির প্রাইভেটকার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁর আয়ে চলে ছয় সদস্যের সংসার। গুলিতে আহত হয়ে শাকিল ২১ দিন ধরে বিছানায় কাতরাচ্ছেন।
রোববার শাকিলের বাড়িতে দেখা যায়, মাটির একটি জীর্ণ ঘরে কোমরের এক পাশে ক্ষত নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন তিনি। ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করা। ব্যথায় ভালোভাবে কথা বলতে পারছিলেন না। পাশে বসেছিলেন তাঁর একমাত্র শিশুসন্তান। সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছিলেন তাঁর স্ত্রী।
এ অবস্থায় শাকিল আহমেদ মৃদু স্বরে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট বেলা তিনটার দিকে শ্রীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মাওনা পল্লী বিদ্যুৎ মোড় এলাকায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তখন সেখানে ছাত্রজনতার সঙ্গে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। সেখানে কী ঘটছে, তা না জেনে তিনি ঘটনাস্থলে মিছিলসহ উপস্থিত হয়েছিলেন। তখন বিজিবির সদস্যদের গুলিতে তিনি আহত হন। তিনি আরও বলেন, প্রচণ্ড শব্দে তাঁর শরীরে গুলি লাগে। তিনি আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যান। কোমরের পাশ থেকে রক্ত ঝরছিল। পাশে থাকা এক ব্যক্তি তাঁকে তুলে পাশের একটি বাড়িতে নিয়ে যান। দেখেশুনে সেখানে উপস্থিত লোকজন মনে করেছিলেন, রাবার বুলেটের আঘাত পেয়েছেন শাকিল। তাই ক্ষতস্থানে কাপড় দিয়ে বেঁধে কয়েকজন মিলে তাঁকে নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তিনি বাড়িতে গিয়ে ব্যথা অনুভব করছিলেন। বিকেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে মাওনা চৌরাস্তার একটি বেসরকারি হাসপাতালে এক্স-রে করিয়ে দেখতে পান তাঁর কোমরের ওপর মেরুদণ্ডের ভেতর একটি বুলেট আটকে আছে। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যান। সেখানে চিকিৎসকেরা আবারও এক্স-রে করিয়ে মেরুদণ্ডে বুলেট থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা শাকিল আহমেদকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেন বলে জানান তিনি। কিছুটা সুস্থ হলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে যেকোনো হাসপাতাল থেকে বুলেট বের করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। পরামর্শ পেয়ে তিনি বাড়িতে চলে আসেন। এরপর ক্রমান্বয়ে তাঁর কোমরে ব্যথা বাড়তে থাকে। তিনি গত শুক্রবার স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের কাছে গিয়ে বুলেট বের করার বিষয়ে পরামর্শ নেন। শাকিল বলেন, চিকিৎসকেরা ধারণা করছেন, বুলেট বের করতে অস্ত্রোপচারে অন্তত ৫ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। কিন্তু এই ব্যয় বহন করে অস্ত্রোপচার করতে না পেরে তিনি বাড়িতে বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন।
কাঁদতে কাঁদতে গুলিবিদ্ধ শাকিল বলেন, ‘আমরা দরিদ্র মানুষ। এই ৫ লাখ টাকা খরচ করার মতো সামর্থ্য আমার নেই। কেউ আমার শরীর থেকে বুলেট বের করে দেন। আমাকে কি কেউ বাঁচাবেন? আমি বাঁচতে চাই। আমার সন্তান এতিম হয়ে যাবে। এই কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।’
শাকিল আহমেদের স্ত্রী মোছা. রিপা বলেন, ‘আহত হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন মানুষটা। কেউ খবর নিল না। ধারদেনা করে চিকিৎসা চালাইতেছি। খেয়ে না খেয়ে সন্তান নিয়ে কোনোরকমে দিন যাইতাছে। এমনে কত দিন চলব জানি না। আমাদের কী হবে, কিছুই বুঝতেছি না।’
শাকিল আহমেদের বাবা মো. নাসির উদ্দিন ছেলের আহত অবস্থায় পড়ে থাকার ঘটনায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের এমন করুণ দশায় আমি অসহায় হয়ে পড়ছি। তাকে নিয়ে আমি কই যাব, কার কাছে যাব। তার ভালো চিকিৎসা করাতে না পারলে তো সে মরে যাবে। আমরা এখন কী করব?’