ত্রাণ নয়, উদ্ধারকারী নৌকার জন্য আকুতি

হঠাৎ ফুঁসে উঠেছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদনদীর পানি। নদীর পানি বেড়ে ১০ জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, নোয়াখালীর আট উপজেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া ও কসবা, রাঙামাটির সাজেক, কুমিল্লা, ফেনী, মৌলভীবাজারের দুটি উপজেলা, চট্টগ্রামের মিরসরাই, চাঁদপুর, সিলেট ও হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। খোয়াই নদীর পানি বিপৎসীমার ১৯০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর বলছে, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে বন্যা দেখা দিয়েছে বাংলাদেশসংলগ্ন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যে। বন্যার কারণে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দিয়েছে। ফলে গোমতী ও ফেনী নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল তলিয়ে গেছে। মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই অবস্থায় উদ্ধারকারী নৌকার জন্য আকুতি জানাচ্ছেন বন্যার্তরা।

ছোট পর্দার অভিনেতা জিয়াউল হক পলাশ বুধবার (২১ আগস্ট) রাত ১টায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার একটি গ্রামের মানুষদের উদ্ধার করার আকুতি জানান।

পলাশ লিখেন, এইমাত্র জানতে পারলাম, ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার ৮নং ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে নিজপানুয়া স্কুল থেকে কিছুটা সামনে ফাজলে আলি মুন্সি বাড়ির সাথে পুরো একটি গ্রামের মানুষ আটকা পড়েছে। ঘরের চাল সমান পানি। কোনো খাবার নেই। কোনো যোগাযোগ নাই। তাদের সাথে সেখানে অনেক বাচ্চা আটকা আছে। যত দ্রুত সম্ভব একটি বোট অথবা ইঞ্জিনচালিত নৌকা দরকার।

একই স্ট্যাটাস নিজের ফেসবুক আইডিতে শেয়ার করে তাদেরকে উদ্ধারের আহ্বান জানাতে দেখা যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহকে।

রাত দেড়টায় ফেনীতে বন্যায় আক্রান্ত অবস্থায় সাহায্যের আকুতি জানিয়ে এক ব্যক্তির পাঠানো মেসেজ ছিল ঠিক এরকম- ‘ভাই আমাদের ত্রাণ লাগবে না। আমাদের স্পিডবোট আর ইঞ্জিন চালিত নৌকা লাগবে। না খেয়ে দু’দিন থাকা যাবে, পানির নিচে দুই মিনিটও না। ভাই, প্লিজ স্বেচ্ছাসেবীদের এটা বলুন।’

রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যের আর্তনাদ বাড়তে শুরু করে। বিভিন্ন গ্রাম, অঞ্চল থেকে একের পর এক মর্মান্তিক খবর ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলার সাধারণ মানুষ নিজেদের বাড়ির ঠিকানা উল্লেখ করে সাহায্যের আকুতি জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিতে শুরু করেন।

একজন লিখেন, ‘আমাদের বাড়িতে ১-২ বছরের বাচ্চা ও বয়স্কসহ মোট ৩৬ জন আটকে আছে, পানি ক্রমশই বাড়ছে, স্পিডবোট ছাড়া উদ্ধার অসম্ভব। এভাবে চলতে থাকলে ঘরের চাল পর্যন্ত পানি রাত ২ টার ভেতরে উঠে যাবে, আমাদের ঘর শেষ, আমাদের বাঁচান। লোকেশন- দৌলতপুর, ১০নং ঘোপাল ইউনিয়ন, ছাগলনাইয়া ফেনী।’

রাত ২টা ৪৫ মিনিটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে জানান, ‘ছাগলনাইয়ার বন্যায় ব্যবহৃত স্পিডবোট বা নৌকার প্রয়োজনীয় তেল মজুমদার পেট্রোল পাম্প থেকে নেওয়া যাবে ফ্রিতে। উদ্ধার কাজে ব্যবহার করার জন্য যে কোনো বোট নিতে আসাদ ভাই অথবা মিশুর সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ করছি (তাদের নাম্বার উল্লেখ ছিল)। আশ্রয়স্থানের প্রয়োজন হলে ছাগলনাইয়া বাজারের মধুমতি মার্কেট, আহমেদ মার্কেটে জায়গা হবে ইনশাআল্লাহ।’

আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল মধ্যরাতেই বন্যার্তদের সাহায্যের ঘোষণা দিয়ে নেমে আসেন। এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, ঘরে থাকতে পারলাম না। বিগত বছরগুলোতে জাহান্নামে ছিলাম। এখন স্পিডবোটে থাকব। আশা করছি. ভোর বেলা থেকে যতটুকু পারি উদ্ধার কাজ করব। আমি ভালো সাঁতার জানি। দোয়া করবেন।’

এরপর ভোর ৫টায় দেওয়া অপর এক স্ট্যাটাসে রাসেল জানান, প্রাথমিকভাবে মেঘনা ঘাট যাচ্ছি। এখানে কোন ট্রলার পেলে এটি নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করব। ট্রলার অ্যাভেইলেবল থাকলে জানাব আমাদের পরবর্তী টিমকে।

এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাতেই ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও স্পিডবোট নিয়ে বন্যা কবলিত এলাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। এছাড়াও দেশের প্রায় সকল সেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো বন্যার্তদের সহযোগীতায় ইতোমধ্যেই বিভিন্ন উদ্যেগ গ্রহণ করেছেন।

এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, অনতিবিলম্বে সরকারি-বেসরকারি সব বোট দেশের বন্যাদুর্গত এলাকায় নিয়োজিত করতে হবে। বৃহস্পতিবার (২২আগস্ট) সকাল ৬টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কার্যালয়ে তথ্য উপদেষ্টা এ কথা বলেন।

বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে তিনি বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আহ্বান করে বলুন প্রধান উপদেষ্টা থেকে নির্দেশ আছে। এক ঘণ্টার মধ্যে কন্ট্রোল রুম চালু করুন।

তিনি আরও বলেন, জাতীয় সংকটের সময় দায়িত্ব পালনে যারা অবহেলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তথ্য উপদেষ্টা বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানকে যেন আর শিক্ষার্থীদের ঘেরাও করা না লাগে। জাতির ক্রান্তিলগ্নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ শুরু করুন। সব বাহিনী উদ্ধার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করুন। আপনাদেরকে যেন আর নির্দেশনা দেওয়া না লাগে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ও সব শ্রেণির মানুষকে তিনি এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই বাঁধ খুলে দিয়েছে। তারা বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আমরা এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। বাংলাদেশের বিপক্ষে যদি কোনো রাষ্ট্র দাঁড়ায় তাহলে আমাদের ছাত্র-জনতা তা রুখে দিবে।

Scroll to Top