কক্সবাজার শহরের সর্বত্র থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। গতকাল সোমবার বিকেলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে হাজারো ছাত্র-জনতা সড়কে নেমে এসে বিজয় উল্লাস করতে থাকেন। বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কক্সবাজার শহরের অভ্যন্তরে থানা, আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসভবন, হোটেলসহ নানা স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
গতকাল বিক্ষুব্ধ লোকজন কক্সবাজার সদর মডেল থানা, ট্রাফিক পুলিশের কার্যালয়, শহরের লালদীঘির পাড়ে জেলা আওয়ামী লীগ, জেলা জাসদ, কিছুটা দূরে কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের মালিকানাধীন হোটেল নীদমহল, বিমান বন্দর সড়কে কক্সবাজার-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিকের মালিকানাধীন হোটেল সৈকত, বিমানবন্দর সড়কের নতুন বাহারছড়া এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম মোজান্মেল হকের বাসভবন ‘হক সন্স’, হলিডে মোড় এলাকার ট্যুরিস্ট পুলিশের অস্থায়ী কার্যালয় সিলভার সাইন, পাশের মুক্তিযোদ্ধা ভবন, মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভবন, সৈকত সড়কের হোটেল–মোটেল জোনের ইকরা বিচ রিসোর্ট, কলাতলী সড়কের ট্রাফিক পুলিশের কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয় শতাধিক দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। কয়েকটি ব্যাংকে হামলা ও এটিএম বুথ ভেঙে টাকা লুটের চেষ্টা হয়েছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এসব ঘটনায় যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা বেশির ভাগই মুখোশধারী শহরের বাইরের লোকজন। ছাত্র আন্দোলনের কেউ এ দলে নেই। শহরের বাইরে গতকাল রাতে মহেশখালীতে তিনজন আওয়ামী লীগ নেতার বাসভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ঈদগাঁও থানাতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। টেকনাফেও আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও কক্সবাজার-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পুরো শহর ঘুরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হলেও সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিক ও শ্রমজীবী মানুষের মনে চরম আতঙ্ক দেখা গেছে। তাঁরা পরিস্থিতি কোনো দিকে যাচ্ছে, তা ভেবে পাচ্ছেন না। সকাল থেকে শহরের প্রধান সড়ক, কলাতলী সৈকত সড়ক ও বাইপাস সড়কে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটম), অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা গেলেও চট্টগ্রাম-ঢাকার পথে কোনো পরিবহন চলাচল করেনি। সব পরিবহনের টিকিট কাউন্টার বন্ধ। হামলা ও লুটপাটের আশঙ্কায় দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। কক্সবাজার সদর মডেল থানাসহ জেলার ৯টি থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ আছে। থানার ফটকে তালা ঝুলছে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা নানাভাবে চেষ্টা করেও হামলা ও লুটপাট বন্ধ করতে পারছেন না। গতকাল রাতে কক্সবাজার প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রাকিব হাসান, শাহেদ বাবু, রবিউল আলমসহ কয়েকজন। তাঁরা বলেন, ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরে কক্সবাজারে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বিজয় উল্লাস করেছি। আমরা কোনো স্থাপনাতে হামলা করিনি। যাঁরা ভাঙচুর, হামলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছেন, তাঁরা তৃতীয় পক্ষের লোক। সমন্বয়কেরা জেলার কোথাও সরকারি–বেসরকারি ভবন কিংবা কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর না করার জন্য আন্দোলনরত ছাত্রদের অনুরোধ জানান।’
কক্সবাজার হোটেল–গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের থাকার হোটেল–মোটেল জোনে হামলা আগুনের ঘটনা পর্যটনশিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটেছে। ছাত্র-জনতা বিজয় উল্লাস করছেন। কিন্তু কিছু মানুষের লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা সাধারণ মানুষকে হতাশ করছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও কারফিউ পরিস্থিতির কারণে গত ১৩ দিনে কক্সবাজারের পর্যটনসহ ১৪টি খাতে ৯০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।