চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার দোয়াভাঙ্গা এলাকার ‘চাঁদপুর হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ’ এর অধ্যক্ষ তামজীদ হোসেনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন অধ্যক্ষ এবং তার সহযোগীদের অনিয়ম, হয়রানি, দুর্নীতি ও প্রতারণায় অতিষ্ঠ হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে শিক্ষক ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই কলেজটি ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৫ সালে। বর্তমানে কলেজের নিয়মিত শিক্ষক ৩৭জন। প্রতিষ্ঠাকালে গুরুত্বপূর্ণ কাজে সহযোগিতা করেন স্থানীয় বেশ কয়েকজন শিক্ষক। কিন্তু তারা অধ্যক্ষ ও তার সহযোগীদের কাছে অনেকটা জিম্মি।
অধ্যক্ষ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর গত ২৭ জুন লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কলেজের প্রভাষক ডা. আবদুল বাসেত, নাজভীন সুলতানা, ফাতেমা বেগম, বিলকিস আক্তার, জান্নাতুল ফেরদাউস, আবুল বাশার, তাজুল ইসলাম ও নুরুল আলম। পদাধিকার বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি।
শিক্ষকরা অভিযোগে উল্লেখ করেন, একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর পর থেকে অধ্যক্ষ মো. তামজীদ হোসেন ও প্রভাষক এমএইচ মোহন দীর্ঘদিন কলেজের নারী শিক্ষার্থীদের কু-প্রস্তাব ও যৌন হয়রানি করছেন। ভয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করতে পারেনি। অনেক শিক্ষার্থী কলেজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি। সর্বশেষ কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সাবিনা (ছদ্মনাম) যৌন হয়রানির শিকার হন। শিক্ষার্থী বিষয়টি অধ্যক্ষের বাবা-মাকে জানান। তাদের কোনো জবাব না পেয়ে কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক আবদুল বাসেত ও ফাতেমা আক্তারের কাছে ঘটনাটি জানান। দুই শিক্ষক ওই যৌন হেনস্থার বিস্তারিত প্রমাণ সংরক্ষণ করেন।
এছাড়া কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে হিসাবরক্ষক নামে থাকলেও বাস্তবে নেই। কে এই ব্যক্তি কেউ জানেন না। ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সব ধরনের ফি আদায়ের হিসাব প্রতিষ্ঠাতা আশরাফ আলী ও অধ্যক্ষ মো. তামজীদ হোসেনের কাছে। তারা বাবা-ছেলে দুজনেই পরিচালনা পর্ষদ ঠিক করেন এবং কলেজের সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখেন। তাদের অনুসারী কয়েকজন শিক্ষক ছাড়া অন্য কোনো শিক্ষক জানতে চাইলে নানা হয়রানির শিকার হন।
অভিযোগকারী শিক্ষকরা বলেন, ২০২২-২৩ অর্থ বছর ছাড়া বাকি সব অর্থ বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব অধ্যক্ষ নিজের মত করে সব অডিট পাশ করিয়ে নেন। ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত শিক্ষকদের কোনো হাজিরা খাতা তৈরি হয়নি। জানতে চাইলে অধ্যক্ষ ডিজিটাল হাজিরার কথা বলে এড়িয়ে যান। নোটিশ বোর্ডে ছুটির ঘোষণা দেয়া হয় না। দিলেও নিজেদের মত করে দেন।
তারা আরও বলেন, কলেজের প্রকৃত ঋণ আছে ১৬ লাখ টাকা। এই বিষয়টি শিক্ষক-কর্মচারীরা সবাই জানে। কিন্তু তারা বাবা-ছেলে বলে বেড়াচ্ছেন ঋণ হচ্ছে ৫২ লাখ টাকা। বাকি টাকা কীভাবে ঋণ হলো এবং কোথায় খরচ হয়েছে এমন ব্যাংক হিসাবও কেউ জানেন না।
প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও প্রভাষক আবদুল বাসেত বলেন, প্রতিষ্ঠাকালীন আমাদের প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুদান ধার্য করা হলেও প্রতিষ্ঠাতা মো. আশরাফ আলী ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। আবার কেউ তিন লাখ টাকার অধিক দিয়েছেন। ২১ জন শিক্ষকের পুরো টাকায় দুর্নীতি করে ১২ শতাংশ সম্পত্তি ক্রয় করেছেন প্রতিষ্ঠাতা নিজের নামে। ওই সম্পত্তি তিনি প্রতিষ্ঠানের নামে দান করে হয়েছেন ভুয়া ভূমি দাতা এবং প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু তিনিই কলেজের মিটিংয়ে বলতেন আপনারাও প্রত্যেকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে থাকবেন। কিন্তু তিনি সেই কথাও রাখেননি।
কলেজের প্রভাষক মো. ইয়াছিন বলেন, কলেজের প্রতিষ্ঠাতা মো. আশরাফ আলী অর্থাৎ অধ্যক্ষের বাবা কলেজের নিজস্ব সম্পত্তি ক্রয় করার জন্য আমাদের ২১জন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রায় ৩ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। এই টাকার হিসেবে অনেকেই সংরক্ষণ না করলেও প্রমাণ হিসেবে আমি ব্যাংকের প্রত্যেকটি রশিদ সংরক্ষণ করে রেখেছি। প্রয়োজনীয় সময়ে তা উপস্থাপন করা হবে।
যৌন হেনস্থার বিষয়ে শিক্ষক এমএইচ মোহন বলেন, আমি এই ধরনের কাজে জড়িত না। অধ্যক্ষের কাছে থাকি এবং তার কাজগুলো করে দেয়ার কারণে আমার নামে এই ধরনের কথা ছড়াচ্ছে।
অভিযোগ সম্পর্কে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আশরাফ আলী বলেন, কলেজের জন্য ৩০ শতাংশ ভূমি ক্রয় করা হয়েছে। এতে শিক্ষদেরও টাকা আছে। আমি যে ১২ শতাংশ ভূমি দান করেছি ওই টাকা আমার। বাকি ১৮ শতাংশ ক্রয় করা হয়েছে সেখানে শিক্ষকদের টাকা আছে। উনাদের টাকায় জমি ক্রয় করে আমি প্রতিষ্ঠানকে দান করিনি। যদি অভিযোগ করে থাকে তাহলে তা মিথ্যা। সবাই একসঙ্গে টাকা দেয়নি। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে কলেজের প্রয়োজনে এবং সবার সম্মতিতে টাকা খরচ করা হয়েছে।
অধ্যক্ষ মো. তামজীদ হোসেন বলেন, বোর্ডের নিয়মের বাহিরে আমি কোনো কাজ করি না। শিক্ষক হাজিরা, আয় ব্যয়ের হিসাব, ছুটির নোটিশসহ যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কোনো টাকা আত্মসাৎ হয়নি।
যৌন হয়রানি সম্পর্কে অধ্যক্ষ তামজীদ বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে, তা মিথ্যা। আমি এই ধরনের কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত না। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার।
শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইয়াসির আরাফাত বলেন, ওই কলেজের শিক্ষকদের অভিযোগ আমি পেয়েছি। অভিযোগের বিষয়গুলো তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন এলে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।