বাংলাদেশে কোরবানির বাজারে সবচেয়ে দামি গরুর দাম কত? ভাবছেন ৫ লাখ কিংবা ২০ লাখ? লাখ নয়, এক কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে একটি গরু। দেড় কোটি ও ৭৫ লাখ টাকায় আরও দুটি গরু বিক্রি হয়েছে। রাজধানীর সাদিক এগ্রো থেকে তিনটি গরু ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকায় কিনেছেন ঢাকার এক ক্রেতা।
মাস দুয়েক আগে রাজধানীতে প্রাণিসম্পদ মেলায় কোটি টাকার একটি গরু এনে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল সাদিক এগ্রো। ফেসবুক আর ইউটিউবে ‘বংশ মর্যাদাপূর্ণ’ কোটি টাকার সেই গরু নিয়ে আলোচনার রেশ এখনও কাটেনি। এরইমধ্যে সাদিক এগ্রো কোরবানির বাজারে দেড় কোটি টাকার আরও একটি গরু তুললেও তা প্রচারে ছিল না। অবশেষে গত সোমবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাহামা জাতের তিনিটি গরুই বিক্রি হয়ে গেছে। দেড় কোটি টাকায় বিক্রি হওয়া বিশেষ গরুটি এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে দামি গরু। এরমধ্যে দিয়ে কোরবানির বাজারের ইতিহাসে তৈরি হলো নতুন মাইলফলক।
প্রাণি বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন দামকে শুধু মূল্য হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এখানে গরুর জিনগত উপাদান লুকিয়ে আছে। অভাবনীয় দামের পেছনে জাতটির নানা উন্নত গুণও আছে।
সাদিক এগ্রোর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, প্রাণি প্রদর্শনীতে কোটি টাকার গরুটি উঠানোর পর অনেকে না জেনে ফেসবুকে নানা রকম নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এখন গরুটি বিক্রি করতে পেরে ভালো লাগছে। বাংলাদেশেও যে দামি গরুর ক্রেতা আছে তা কোটি টাকার গরু বিক্রির মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বে এরচেয়েও দামি গরুও আছে। গত মার্চে ব্রাজিলে একটি গাভী ৫২ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এক কোটি টাকার গরুটির ওজন ১৪০০ কেজি বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু গরুর দাম কোটি টাকা কেন? ইমরান হোসেন বলেন, গরুটার দাম এক কোটি চাওয়া হচ্ছে, এটার অনেক কারণ আছে। এক নম্বর হচ্ছে, এই গরুটার ১১০ বছরের পেডিগ্রি (বংশ পরম্পরা লিপিবদ্ধ) আছে। আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে এই গরুটার বাবা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন ব্লাডলাইন। এটা হচ্ছে আমেরিকান ভিএইট নোবেল সিরিজ, ওদের সবচেয়ে বেস্ট সিরিজ এটা, এই সিরিজের গরু। এই জাতের গরু মোস্ট লেস কোলেস্টেরল যুক্ত মাংস উৎপাদনকারী গরু। এই গরুর মাংস খেলে কোলেস্টেরল কম হবে। মাংসগুলো খুবই উন্নত মানের। বাজারের ৭০০ টাকার মাংসের সঙ্গে এটার তুলনা করা যাবে না। ৫ কেজি দানাদার খেয়ে এই গরু এক কেজি মাংস উৎপাদন করতে সক্ষম। অথচ দেশীয় জাতের গরু ১২-১৭ কেজি দানাদার খাবার খেয়ে এক কেজি মাংস উৎপাদন করে। তাছাড়া কম খাদ্য খেয়ে দ্রুত বড় হতে পারে। এটা মাংসের চিন্তা করে না, ওজনের চিন্তা করে না। বরং এই গরুটা বংশ মর্যাদাপূর্ণ গরু। এর জন্য দাম বেশি। গরুটির গায়ে থাকা রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে গুগলে সার্চ দিলে তার ১১০ বছরের ইতিহাস চলে আসবে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে ছয়টি ব্রাহামা জাতের গরু আছে। এ বছর আমরা তিনটি প্রস্তুত করেছিলাম। তিনটিই বিক্রি হয়ে গেছে। আগামী বছর কোরবানিতে বাকি তিনটি বিক্রি করবো।
দেড় কোটি টাকার গরুর বিষয়ে তিনি বলেন, এই গরুটি এক কোটি টাকার গরুর চেয়ে উচ্চতায় বড়। এর নাম রেখেছি সুলতান। ওজন ১৫০০ কেজি। কালো-সাদার সংমিশ্রণে গরুটির রাজকীয় ভাব আছে। গরুটির হাটা চলা কিংবা দাঁড়ানোর ওপরও আমেরিকায় দাম নির্ভর করে। এটি আরও বড় হওয়ার সুযোগ আছে। আমেরিকান ব্রাহামা জাতের গরুটির গায়ে থাকা রেজিস্ট্রেশন নম্বর এইচডি-১৬৪ গুগলে সার্চ দিলেই সব তথ্য পাওয়া যাবে। আমেরিকায় গরুটি কত টাকায় বিক্রি হয়েছে, এটি এখন কার কাছে আছে, এর বৈশিষ্টসহ সব জানা যাবে। আমাদের আরেকটি ব্রাহামা জাতের গরু এবার বিক্রি হয়েছে ৭৫ লাখ টাকায়। এই জাতের গরু উষ্ণ আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। ফলে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে এই গরু পালন অত্যন্ত সুবিধাজনক। অত্যন্ত শক্তিশালী এ গরুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি, আর, মাংসও অত্যন্ত উচ্চমানের।
ব্রাহামার জাত প্রসঙ্গে মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ব্রাহামা আমাদের উপমহাদেশেরই জাত। ১১০ বছর আগে আমাদের এই অঞ্চলেরই তিনটি গরু আমেরিকানরা নিয়ে গিয়ে ‘ব্রাহামা’ জাত তৈরি করেছে। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় ব্রাহামা জাতের গরু খুব ভালো বাড়ে। আমরা এখন ব্রাহামা ব্রিড করছি। দেশের অনেক খামারিই এখন লোকাল ব্রাহামা করছে। সেগুলোর ফলাফলও ভালো। লোকাল ব্রাহামার বৃদ্ধিও ভালো এবং সেগুলো ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে। মাংসের চাহিদা পূরণে ব্রাহমা জাতের গরু উৎপাদনে সরকার এক দশক আগে নানা প্রকল্প নেয়। খামারিরা যখন ব্রাহামা গরু পালন করে মাংসের উৎপাদন বাড়াতে থাকেন, তখনই এটি আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দেশীয় জাতের গরু কৃত্রিম প্রজননের জন্য ৪ ধরনের সিমেন প্রস্তুত করে। আরসিসি বা নর্থ বেঙ্গল গ্রে বা শাহীওয়াল বা মুন্সীগঞ্জ- এসব জাতের গরু থেকে দুধ উৎপাদন করা সম্ভব নয়; শুধু মাংস উৎপাদন করা যায়। এ জাতের একটি ২ বছরের গরু থেকে ১২০-১৫০ কেজি মাংস পাওয়া যায়। অপরদিকে দেশীয় গরুর সঙ্গে এসব জাত সংকরায়ন না করে যদি ব্রাহমার মতো উন্নত জাতের সংকরায়ন করা হয়, তাহলে ২ বছরের একটা গরু থেকে দ্বিগুণ অর্থাৎ ২৫০-৩০০ কেজি মাংস আহরণ সম্ভব। এ পদক্ষেপেই মাংসের উৎপাদন খরচ অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
গরুর পাশাপাশি সাদিক এগ্রো এবার ১৮০ কেজি ওজনের একটি ছাগল বিক্রি করেছে ১৫ লাখ টাকায়। সাদিক এগ্রোর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের খামারে থাকা পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার খাসিটি নিয়ে হইচই পড়ে যায়। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার এক ক্রেতা কিনে নিয়েছেন ধূসর বাদামি রঙের পশুটি। এটিই বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় খাসি বলে প্রতিষ্ঠানটির দাবি।
কোরবানির ঈদ উপলক্ষে দৃষ্টিনন্দন সাজে সেজেছে পুরো সাদিক এগ্রো। রকমারি পশু দেখতে ভোররাত পর্যন্ত থাকছে ক্রেতার ভিড়। গত সোমবার রাতে খামার পরিদর্শন করেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুস শহীদ।
সাদিক এগ্রোর মালিক মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে সব বাজেটের ক্রেতার জন্যই কোরবানি উপযোগী পশু আছে। ১৫ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের ছাগল আছে। শুধু ছাগল নয়, গরু, মহিষ, দুম্বা, উট, ভেড়া, গাড়ল, গয়াল, পাঙ্গানুর গরুসহ সাড়ে ৩ হাজার পশু বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আমাদের কাছে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় কোটি টাকা গরু আছে। ১৫ হাজার টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকার খাসি আছে। ৩০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা বেড়া আছে। দেড় লাখ থেকে ৫ লাখ টাকার দুম্বা আছে। দেড় লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা দামের ভুট্টি গরু আছে। সৌখিন মানুষের কথা চিন্তা করে বড় গরুর পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ছোট গরুরও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. কেবিএম সাইফুল ইসলাম বলেন, মুরগির মাংস উৎপাদনের জন্য আমাদের ব্রয়লার আছে। গরুর মাংস উৎপাদনের জন্য মাংস উৎপাদনকারী জাত আছে বিশ্বের সব দেশে। দুর্ভাগ্যবশত আমরা বাংলাদেশে এরকম কোনো জাত উন্নয়ন করতে পারিনি। শুধুমাত্র উন্নত জাত থাকায় বাংলাদেশের চেয়ে অর্ধেক খরচে গরুর মাংস উৎপাদন করে ব্রাজিল। প্রাণিজ আমিষের বাজার সহজলভ্য করতে দেশের এমন জাত উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি।