প্রখর রোদের মধ্যে চা-বাগানে দাঁড়িয়ে শ্যালো মেশিনের পাইপ দিয়ে পানি সেচ দিচ্ছিলেন চা-চাষি আবুল হাসান (৫৫)। চায়ের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এবার চায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। গত মৌসুমে চা-পাতার দাম না পাওয়ায় টাকার অভাবে বেশি যত্ন নিতে পারিনি। এ জন্য পোকার আক্রমণ বেড়ে গেছে। তার ওপরে এখন খরায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বেশি রোদ হলে চা-গাছে নতুন কুঁড়ি আসে না।’
চা-চাষি আবুল হাসান পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের ডাউলিয়া ভিটা এলাকার বাসিন্দা। গত মঙ্গলবার দুপুরে বাড়ির কাছাকাছি চা-বাগানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি আরও বলছিলেন, ‘আমার আট বিঘা চা-বাগান আছে। গত বছর মৌসুম শুরুর প্রথম দুই মাসে সেখান থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কেজি পাতা বিক্রি করেছিলাম। এবার মৌসুম শুরুর দুই মাস চলে গেছে, কিন্তু একটা পাতাও বিক্রি করতে পারিনি। দেখি, পানি সেচ দিয়ে কতটা ফেরানো যায়।’
কাঁচা চা-পাতার দরপতন আর তীব্র তাপপ্রবাহে পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় সব চা-চাষিই এখন পড়েছেন বিপাকে। পঞ্চগড়ের বেশির ভাগ চা-বাগানে আসছে না নতুন কুঁড়ি। সেই সঙ্গে গত এক মাসের তাপপ্রবাহে লাল মাকড়ের আক্রমণসহ নানা প্রকার পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়েছে। বেশির ভাগ চাষিই চা-বাগান নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে।
চা-চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০০ সাল থেকে সমতল ভূমিতে চা চাষ শুরুর এক দশকের মধ্যে ক্ষুদ্র চাষি পর্যায়ে চায়ের চাষ শুরু হলে পুরো জেলার চেহারা বদলে যেতে থাকে। আশপাশের আরও চার জেলায় সমতল ভূমিতে চা চাষ ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সাল পর্যন্ত সমতলের চা-চাষিরা সুদিন দেখেছেন। তখন কারখানামালিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে চা-চাষিরা কাঁচা চা-পাতা বিক্রি করে কেজিতে ৩৩-৩৯ টাকা পর্যন্ত দাম পেয়েছেন। কিন্তু এর পর থেকেই প্রতিবছর চায়ের দাম কমার কারণে উত্তরের চা-চাষিদের দুর্দিন শুরু হয়।
গত বছর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পার করেছেন সমতলের চা-চাষিরা। কাঁচা চা-পাতার এতটাই দাম কম পেয়েছেন তাঁরা, বছরজুড়ে চা-বাগানের পরিচর্যা করার মতো টাকা ছিল না তাঁদের। আর এতেই এ বছর আরও বড় দুর্বিপাকে পড়েছেন এই ক্ষুদ্র চা-চাষিরা। এর সঙ্গে গত এক মাসের টানা তাপপ্রবাহে এবার নতুন কুঁড়ি আসছে না জেলার চা-বাগানগুলোতে।
চা–বাগানে প্রতিবছর দুবার সার প্রয়োগ করতে হয়। এ ছাড়া খরার মৌসুমে ১৫ দিন পরপর পানি সেচ দিতে হয়। সেই সঙ্গে বছরে সর্বনিম্ন ছয়বার কীটনাশক ছিটাতে হয়। তবে পোকামাকড়ের আক্রমণ অনুযায়ী এটি কমবেশি হতে পারে। টাকার অভাবে চা-বাগানের পেছনে এই নিয়মিত বিনিয়োগ ও পরিচর্যা করতে না পারায় এবার চা-গাছে লাল মাকড়ের আক্রমণসহ নানা প্রকার পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়েছে। এর সঙ্গে টানা তাপপ্রবাহ যোগ হয়ে সমতলের চা-চাষিদের এখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ অবস্থা।
প্রতিবছরের ১ মার্চ কারখানাগুলো উৎপাদন শুরু করে। এবারও মার্চের শুরুর দিকে সমতলের চায়ের মৌসুম শুরু হলেও বাগানগুলো থেকে আশানুরূপ পাতা সংগ্রহ করতে পারছেন না চাষিরা। এতে পাতার অভাবে উত্তরাঞ্চলে ২৮টি চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মধ্যে অর্ধেকের বেশি কারখানাই চালু করা সম্ভব হয়নি।
চাষিরা বলছেন, গত বছর চা-চাষিদের ১০ থেকে ১৫ টাকার মধ্যে কাঁচা চা-পাতা বিক্রি করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে ভেজা ও খারাপ চা-পাতার কথা বলে ওজনে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত চা-পাতা বাদ দিয়ে হিসাব করেছেন কারখানামালিকেরা। এতে প্রতি কেজি চা বিক্রি করে আট টাকাও টেকেনি চাষিদের। অথচ প্রতি কেজি চায়ের উৎপাদনে ১৮ টাকার মতো খরচ হয় তাঁদের।
উৎপাদন খরচ তুলতে না পারায় চাষিরা বিভিন্ন সময় প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন। প্রায় এক মাস ধরে যেসব কুঁড়ি বের হয়েছে, সেগুলো রোদে পুড়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া চা-পাতাগুলো বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। পরিমিত বৃষ্টি না হওয়ায় রোদের তাপে চা-গাছে লাল মাকড়, থ্রিপস, জেসিডসহ বিভিন্ন পোকার আক্রমণ বেড়ে গেছে। এতে কাঁচা চা-পাতার উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এখন পানি সেচ দিয়ে ও কীটনাশক ছিটিয়েও তেমন কোনো কাজে আসছে না।
কয়েক দিন ধরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার আমতলা, জগদল, কাজীর হাট, ভিতরগড়, সোনারবান; তেঁতুলিয়া উপজেলার বোয়ালমারী, আজিজনগরসহ বিভিন্ন এলাকার চা-বাগানগুলো ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত হলো চায়ের উৎপাদন মৌসুম। টাকার অভাবের সঙ্গে শ্রমিকের অভাবেও ক্ষুদ্র চা-চাষিরা বাগানের পরিচর্যা থেকে শুরু করে চা তোলার কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারছেন না।
সিলেটের চা-বাগানগুলোতে শ্রমিকেরা হাত দিয়ে চায়ের পাতা তোলেন। আর পঞ্চগড়ের চাষিরা পাতা কাটেন ধান কাটার কাস্তে দিয়ে। হাত দিয়ে পাতা তুললে প্রতি মৌসুমে ৩০ থেকে ৩২ দফা পাতা তোলা যায়। আর কাস্তে দিয়ে পাতা কাটার কারণে নতুন কুঁড়ি আসতে সময় লাগে। দক্ষ শ্রমিকের অভাবে পঞ্চগড়ের চাষিরা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ কারণে বিক্রির সময় খারাপ চায়ের কথা বলে ওজনে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত চা-পাতার দাম পাচ্ছেন না তাঁরা। এতে লোকসানের অঙ্ক আরও বড় হচ্ছে।
২০২০ সাল পর্যন্ত সমতলের চা-চাষিরা সুদিন দেখেছেন। তখন কারখানার মালিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে চা-চাষিরা কাঁচা চা-পাতা বিক্রি করে কেজিতে ৩৩-৩৯ টাকা পর্যন্ত দাম পেয়েছে। কিন্তু এর পর থেকেই প্রতিবছর চায়ের দাম কমার কারণে উত্তরের চা-চাষিদের দুর্দিন শুরু হয়।
অনেকে বাগান কেটে ফেলছেন
জমিতে একবার চা লাগালে তা ১০০ বছরের বেশি সময় বাঁচতে পারে। পঞ্চগড়ের উঁচু জমিগুলোতে আগে প্রযুক্তির অভাবে সেচ ও কর্ষণ দেওয়া যেত না বলেই তেমন ফসল হতো না। চা চাষ স্থানীয় কৃষকদের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। যদিও ইদানীং ট্রাক্টর-পাওয়ার টিলার ও সেচযন্ত্র চলে আসায় জমিতে অন্যান্য ফসল উৎপাদনও সহজ হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে চায়ের লোকসানে অনেক চাষি তাঁদের বাগান কেটে ফেলে ফসল চাষ শুরু করছেন।
গরমে চা-চাষিদের মাথায় হাত
চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চা চাষের জন্য ২৮ ডিগ্রি থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা আদর্শ। বর্তমানে এই এলাকায় এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করায় চা উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ চা-বাগানে ছায়াবৃক্ষ (শেড ট্রি) না থাকায় প্রচণ্ড রোদ আর গরমে বাগানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চা-বাগানগুলো থেকে মানসম্মত চা-পাতা উৎপাদনের জন্য বাগানে শেড ট্রি হিসেবে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চাষিদের কালো কড়ই ও সাদা শিরীষগাছ রোপণের পরামর্শ দেয় চা বোর্ড।
চা–বাগানে ছায়াবৃক্ষ থাকলে গুণগত মানসম্পন্ন চা–পাতা উৎপাদনের পাশাপাশি চা–গাছের পাতা শীতল থাকায় পোকার আক্রমণ, বিশেষ করে লাল মাকড়ের আক্রমণ কমে যায়। এ ছাড়া ছায়াবৃক্ষ খরা মোকাবিলায় সহায়তার পাশাপাশি ছায়াবৃক্ষের ছোট ছোট পাতা বাগানে ঝরে পড়ে পচে যাওয়ার পর জৈব সার হিসেবে কাজে লাগে।